উপজেলার শাহজাদাপুর ইউনিয়নের দেওড়া গ্রামের মোল্লাবাড়ির প্রয়াত সাজিদ মোল্লার ছেলে মৌলভী মলাই মিয়া। ছোটকাল থেকেই গাছকে খুবই ভাল বাসতেন তিনি। বাড়ির পাশেই জমির আইলে বেড়ে ওঠেছিল একটি জারূল গাছ। কৃষক, পথচারি, মাঠে আসা লোকজন, অগণিত পশু পাখির আশ্রয় ও সুখের কথা ভেবেই দেওড়া গ্রামের পূর্ব পাশের হাওরের মাঝখানে একটি গাছ রোপনের চিন্তা করেন মৌলভী। গাছের গোড়ার মাটি কেটে তুলে নিয়ে তিনি ফসলি মাঠের সড়কের পাশের সেই জায়গায় গাছটি রোপন করেন। নিয়মিত সেবাযত্নে দ্রূত বড় হয়ে ওঠে গাছটি। ৪/৫ কিলোমিটার এলাকায় তপ্ত রোদ্রের মাঝখানে একটু ছায়া। সুশীতল বাতাস। তৃপ্তির নি:শ্বাস ছাড়েন কুষক পথচারি ও রাখালরা। ভুলে যান জারূল নাম। গাছটি রোপন করেছেন মলাই মিয়া। প্রথম দিকে সকলেই পরিচয় দিতে থাকেন মলাই মিয়ার গাছ। এক সময় সব ভুলে লোকজন গাছটিকে ডাকেন মলাই গাছ। গ্রাম ইউনিয়নের গন্ডি পেরিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে মলাই গাছের পরিচয়। এ যেন আরেক নতুন ইতিহাসের জন্ম দিল। জারূল গাছটি ‘মলাই গাছ’ নাম ধারণ করল স’ায়ীভাবে। এরপরও অনেকেই প্রশ্ন করেন গাছটি তো জারূল। মলাই কিভাবে ও কেন হলো? অনুসন্ধানে গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও মোল্লাবাড়ির লোকজন জানায়, ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের অগ্রহায়ণ মাস। তখন পাকিস্তান শাসন চলমান। শাসক ছিলেন ইস্কান্দর মির্জা। সাজিদ মোল্লার ছেলে মলাই মিয়া ছিলেন আল্লাহভক্ত একজন ধার্মিক লোক। উনার ছিল অনেক মুরিদান। সর্বজন শ্রদ্ধেয় ওই ব্যক্তিটি ছিলেন একজন ভাল কৃষক। অগ্রহায়ণ মাসে মাঠে ধান কাটার নেতৃত্ব দিতেন মলাই মিয়া। তখন শাহজাদাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন আব্দুল ময়েজ খাঁ। বর্তমান মলাই গাছের চারাটি ছিল তাদের বাড়ির পাশের চুন্নুর বাড়ির পূর্বদিকে উলু টুকরার পশ্চিম আইলে। গাছটির গোড়ার মাটি সরাতে লেগেছে ১০ দিন। স’ানীয় আওয়ালের বাপসহ মোট ৪ জন রশি বাঁশ দিয়ে গাছটি নিয়ে রওনা দেয়। গর্ত খনন করে সেখানে অপেক্ষা করছিলেন মলাই মোল্লা ও তার বাবা সাজিদ মোল্লা। এরই মধ্যে লোক পাঠিয়ে গাছ লাগানোর কারণ জানতে চাইলেন চেয়ারম্যান। তারা জানালেন জনস্বার্থে। চেয়ারম্যান সন’ষ্ট হলেন। বাপ ছেলে গাছটি রোপর করলেন। রোপনের পর বেশ কয়েকবার প্রবল বন্যা হয়েছে। আল্লাহর রহমতে কিছুই হয়নি গাছটির। ফসলি মাঠের সড়কের পাশে ৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকার একমাত্র ছায়াদানকারী গাছ এটি। বড় ছাতার মত ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে সবুজ আকৃতির এই গাছটি। প্রচন্ড তাপদাহে মাঠে কাজ করছেন কৃষক শ্রমিক। অঝরে ঝরছে ঘাম। ক্লান্তি দূর করতে ছুটে আসছেন গাছের ছায়াতলে। কেউ খাচ্ছেন ভাত। কেউ পান করছেন পানি। অনেকে নীচে বসে নিচ্ছেন বিশ্রাম। কেউ সুর তুলছেন বাঁশের বাঁশিতে। মনমুগ্ধকর ও হৃদয় কাড়া সুরের মুর্চ্ছনা। গরূ মাঠে ঘুরে ফিরে ঘাস খাচ্ছে। আর রাখাল ওই গাছের নীচে বসে দিচ্ছেন পাহাড়া। বৃষ্টি বা ঝড়ের সময়ও শতশত মানুষের আশ্রয়স’ল এই গাছটি। ভিন্ন ধরণ ও আকৃতির পাখিও দিনরাত বসে থাকে ওই গাছটির মগডালে। বন্যার সময় গাছটিতে আশ্রয় নেয় সাপ ও ব্যাঙ। দিনের বেলা ডালে ডালে দেখা যায় পাখির মেলা। মাঠের চারিদিক থেকে এই গাছটি ৫-৬ গ্রামের পথ নির্দেশ করে। ভরা বর্ষায় এই গাছটিই যাত্রীবাহী ও পণ্যবোঝাই নৌকাকে দেয় পথের দিশা। এমনই ভাবে ৮০ বছরেরও অধিক সময় ধরে মলাই গাছটি শাহজাদাপুর শাহবাজপুর ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। কোন দিনও চাইনি বিনিময়। গাছটির জন্মই যেন পরোপকারের জন্য। তবে ছায়া শান্তি উপভোগকারী লোকজন দোয়া করেন রোপনকারীর জন্য। প্রয়াত মলাই মিয়ার নাতি এডভোকেট মোহাম্মদ মোকাররম জাহান বলেন, দাদা ছিলেন গাছ প্রেমি। গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে হাওরের মাঝখানে রোপন করেছিলেন জারূল গাছ। সেবার মাধ্যমে এই গাছটি আজ ইতিহাস হয়ে গেল। লোকজন যখন বলে ‘মলাই গাছ।’ তখন খুবই ভাল লাগে গর্বে বুকটা ভরে যায়। গাছটির ইতিহাস নিয়ে যারা কাছ করছেন সকলের কাছে আমি ও আমাদের পরিবার কৃতজ্ঞ। দেওড়া গ্রামের প্রবীন মুরব্বি প্রয়াত চেয়ারম্যান আব্দুল ময়েজ খানের বড় ছেলে মো. আকরাম খান (৮৫) বলেন, ছোটকাল থেকেই মলাই গাছটি দেখে আসছি। হাওরের মাঝখানে সেবার ভান্ডার নিয়ে বসে আছে গাছটি। এটি প্রয়াত মলাই মিয়ারই অবদান। যতদিন গাছটি জীবিত থাকবে ঘুরে ফিরে ইতিহাস মলাই মিয়াকে স্মরণ করতেই হবে।
মাহবুব খান বাবুল