Dhaka ০২:৪৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
News Title :
পাক্ষিক মত ও পথ এর সম্পাদক হওয়ায় প্রফেসর ফাহিমা খাতুন কে অভিনন্দন নবীনগরে সওজের জায়গায় তৈরি হচ্ছে অবৈধ দোকান: চলছে কোটি টাকার দখল বাণিজ্য। ফেইক আইডি’র মাধ্যমে প্রার্থীর বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্র শঙ্কায় থানায় অভিযোগ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন প্রার্থীতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেন সরাইল বিএনপি’র সাবেক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পশ্চিম পাইকপাড়ায় ইমারত আইন অমান্য করে ভবন নির্মাণের অভিযোগ সরা্‌ইলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ বিষয়ক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত সরাইলে ধান কাটাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় চেয়ারম্যান, সাংবাদিকে আসামী করে মামলা সারাদেশে হিট এলার্ট; চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১.৩ সাহিত্য একাডেমির বৈশাখী উৎসবের চতুর্থ দিনে মুজিবনগর দিবস পালন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস পালিত

খড়মপুরের ওরশ : কিছু কথা

  • Reporter Name
  • Update Time : ১২:৪৩:১০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অগাস্ট ২০২৩
  • ১০৮ Time View

♦খড়মপুর মাজারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস♦

🔳এইচ.এম. সিরাজ🔳

❝ ছুটছে মানুষ দলে দলে নৌ সড়ক আর রেলে,
ভক্ত-বাউল-আশেকানের খড়মপুরের ডাক দিলে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় দরগাহ্ সৈয়দ কল্লাহ্ শাহ্’র,
সপ্তাহ জুড়েই চলবে ওরশ হবে গান জিকির-আযকার। ❞

♦খড়মপুর মাজারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস♦

ঐতিহ্যমণ্ডিত খড়মপুর। তিতাসপাড়ের এক পূণ্যভূমিও বটে। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের এই বাংলাদেশে আগমণকারী ৩৬০ আউলিয়ার মধ্যে ১২ জন ছিলেন শীর্ষতম। এই ১২ জনেরই একজন চিরশায়িত আছেন খড়মপুরে। আউলিয়ার এই দরগাহ্ তথা মাজার শরীফ’র জন্যই সমগ্র দেশবাসীর কাছে এমনকি পার্শ্ববর্তী কতেক দেশেও এই খড়মপুর অত্যন্ত সুপরিচিত। যার কারণে খড়মপুর দেশে-বিদেশে পরিচিত, তিনি হলেন হযরত শাহ্ পীর সৈয়দ আহাম্মদ গেছুদারাজ প্রকাশ্য শাহ্ পীর কল্লাহ্ শহীদ (রহ.)। এই দেশে আগমণকারী আউলিয়া সম্রাট হযরত শাহ্ জালাল ইয়ামেনী (রহ.) এর শিষ্যদের অন্যতম একজনও ছিলেন হযরত শাহ্ পীর সৈয়দ আহাম্মদ গেছুদারাজ (রহ.)। তিনিই বঙ্গ দেশে আগমণকারী শীর্ষতম ১২ আউলিয়ারও একজন, যে ১২ আউলিয়া নিয়ে বহু লোকজ কাহিনী আর ঐতিহ্য বিদ্যমান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সীমান্তবর্তী আখাউড়া উপজেলা সদরের তিতাস-সাইনধারা নদীর তীরবর্তী খড়মপুর গ্রামে অবস্থিত এই আউলিয়ার মাজার। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট রেলপথ এবং ঢাকা-আগরতলা সড়কপথ গমণ করেছে এই খড়মপুরেরই কোল ঘেষে। তাছাড়াও তিতাসপাড়ে অবস্থিত বিধায় নদীপথে এই খড়মপুরের মাজারে যাতায়াত করা অনেকটাই সহজতর। বিশেষত বর্ষাকালে দরগাহ্ ঘাটেই ভিড়ে ভক্ত-আশেকানদের নৌকা। এই সময়ে খড়মপুর দরগাহে দর্শনার্থীর আগমন ঘটে চোখে পড়ার মতো। সবকিছু মিলিয়ে বর্ষা মৌসুমে খড়মপুরে লোক সমাগম অনেকাংশেই বৃদ্ধি পায়। মাজারকে কেন্দ্র করে এ খড়মপুর তথা গোটা আখাউড়া উপজেলায় লেগেছে দৃশ্যমান পরিবর্তনের ছোঁয়া-ঘটেছে ব্যাপকতর উন্নতি। এখানকার জীবনমানের এমনকি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও অনেকটাই চোখে পড়ারই মতো এই মাজার তথা দরগাহকে ঘিরে। ঐতিহ্যবাহী এ মাজার ‘কেল্লা শহীদের দরগাহ্’ নামেও সমধিক পরিচিত।

খড়মপুরের দরগাহ্ সম্পর্কে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একটি লোকজ কাহিনী প্রচলিত আছে। যা লোকসঙ্গীত তথা বাউল সঙ্গীতের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে অতীব তাৎপর্যময়তার পাশাপাশি হয়ে ওঠেছে ইতিহাস এবং সাহিত্যেরও অংশ বিশেষ। আর তা হচ্ছে, তিতাসপাড়ের এই খড়মপুর গ্রামটিতে একদা ছিলো কৈবর্তদের (জেলে) সম্প্রদায়ের লোকদের বসবাস। একদিন চৈতন দাস ও তার সঙ্গীরা তিতাস নদীতে জাল ফেল মাছ ধরছিলেন। আচমকাই তাদের জালে একটি ‘খণ্ডিত শির’ আটকা পড়ে। এমনি অভাবনীয় দৃশ্য দেখে চৈতন দাসসহ উপস্থিত জেলেরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং খণ্ডিত শিরটিকে ওঠাতে গেলে আল্লাহ্’র কুদরতেই খণ্ডিত শির বলতে থাকে,- ❝ একজন আস্তিকের সাথে আরেক জন নাস্তিকের কখনোই কোনো প্রকারের মিল হতে পারে না। তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত পবিত্র কলেমা পাঠ করে মুসলমান না হবে, ঠিক ততোক্ষণ পর্যন্ত আমার মস্তক স্পর্শ করবে না। ❞

খণ্ডিত মস্তকের জবানে এমনি কথা শুনে মস্তকের কাছ থেকে কলেমা পাঠ করে চৈতন দাস ও তদীয় সঙ্গীরা তৎক্ষনাতই তাদের সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে যান। ধর্মান্তরিত হবার পর ওই জেলেদের নাম হয় শাহবলা, শাহলো, শাহজাদা, শাহগোরা ও শাহ রওশন। তাঁরাই খড়মপুর দরগাহের আদি বংশধর। তৎসময়ে মাত্র ২৮ ঘর বসতি ছিলো খড়মপুর গ্রামটিতে। আর তারা সকলেই ছিলেন কৈবর্ত সম্প্রদায়ের। তাদের প্রধান জীবিকা ছিলো গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী তিতাস নদীর বুকে জাল ফেলে মাছ আহরণ করা। উপরোক্ত ঘটনার পর ২৮ ঘর কৈবর্তের সকলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে শাহ্ উপাধি লাভ করেন। অপরদিকে মস্তকের নির্দেশনা মোতাবেক ইসলামী মতে খড়মপুর (তিতাস পাড়ে) কবরস্থানে মস্তক দাফন করা হয়। সেই থেকেই এটি শাহ্ পীর সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ প্রকাশ্য শাহ্ পীর কল্লাহ্ শহীদ’র (রহ.) মাজার নামে পরিচিতি লাভ করে। তিতাসপাড়ের ২৬০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত খড়মপুর দরগাহ্ শরীফের জায়গা ভারতবর্ষের আগরতলা রাজ্যের তদানীন্তন মহারাজা দান করেন।

বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেন যে, তরফ বিজয়ী আউলিয়া সম্রাট হযরত শাহ্ জালাল ইয়ামেনী (রহ.) এর নেতৃত্বে দিল্লী হয়ে বাংলায় ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে যে ৩৬০ জন আউলিয়া সিলেট এলাকায় এসেছিলেন হযরত সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ ছিলেন হযরত শাহ্ জালাল’র (রহ.) শিষ্যদের অন্যতম একজন। তদানীন্তন সময়ে গৌর গোবিন্দ ছিলেন তরফ রাজ্যের রাজা। ওই এলাকায় বোরহান উদ্দিন নামের একমাত্র মুসলমানের শিশুপুত্রকে গৌর গোবিন্দ রাজার লোকেরা কতল করে ফেলেন। অত্যাচারী ওই রাজার অনাচারকে থামাতে ৩৬০ আউলিয়া তরফ রাজ্যভূক্ত আজকের সিলেট জনপদে আগমণ করেন। খবর পেয়ে তাঁদের আগমণ ঠেকাতে রাজা গৌর গোবিন্দ সুরমা নদীর খেয়া পারাপার বন্ধ করে দেন। তখন হযরত শাহজালাল ইয়ামেনী (রহ.) নিজের জায়নামাজটিকে বিছিয়ে শিষ্যদের নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন সুরমা নদী। আউলিয়া সম্রাটের এমনি কেরামতিপূর্ণ ঘটনার পর রাজা গৌর গোবিন্দ পরাজয় থেকে নিজেকে রক্ষায় নতুন করে এক ফন্দি আঁটলেন।

রাজা গৌর গোবিন্দ তার আঁটা ফন্দি মোতাবেক রাজ্যের অনিন্দ সুন্দরী নারীদেরকে নগ্ন হয়ে সৈন্যদলের সামনে থাকার নির্দেশ দেন, যাতে মুসলমানেরা ঈমান হারাবার ভয়ে পিছু হটে যান। এমনি অবস্থায় হযরত শাহজালাল’র (রহ.) পরামর্শ মতে ওনার শিষ্য তথা সৈনিকেরাও অভিনব এবং কেরামতিপূর্ণ পন্থানুসরণ করেন। সকলেই পূর্ণ এখলাসের সাথে স্বীয় শিরকে আল্লাহ্’র হুকুমে ধর থেক সরে যেতে এবং যুদ্ধ শেষে স্বস্থানে ফিরে আসতে বললেন। একমাত্র সৈয়দ আহাম্মদ গেছুদারাজ তাঁর শিরকে ফিরে আসতে বলেন নি। হযরত শাহ্ জালাল’র (রহ.) প্রধান সেনাপতি হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (রহ.) পরিচালিত সংগঠিত যুদ্ধে রাজা গৌর গোবিন্দ পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। আর নিজের শিরকে ফিরে আসতে না বলায় ওই যুদ্ধে হযরত সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ (রহ.) শহীদ হয়েছিলেন এবং তাঁরই মস্তক পানিতে পড়ে স্রোতের সাথে ভাসতে ভাসতে তিতাস নদীর এই খড়মপুর এলাকায় এসে জেলেদের জালে আটকা পড়ে। আর এ সঙ্গতেই শাহ্ পীর সৈয়দ আহাম্মদ গেছুদারাজ (রহ.)’র মাজারকে প্রকাশ্য শাহ্ পীর কল্লাহ্ শহীদ (রহ.) এর মাজার কিংবা দরগাহ্ নামেও সমধিক পরিচিত।

ঐতিহ্যবাহী এই খড়মপুরস্থ ‘কেল্লা শহীদের দরগাহ্’-তে প্রতিবছর বাংলা শ্রাবণ মাসের ২৬ থেকে ০১ ভাদ্র মোতাবেক ১০-১৬ আগস্ট তারিখ পর্যন্ত সাত দিনব্যাপী বাৎসরিক ওরশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভক্ত-বাউল- আশেকান ছাড়াও লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে।
#
এইচ.এম. সিরাজ : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় খবর

পাক্ষিক মত ও পথ এর সম্পাদক হওয়ায় প্রফেসর ফাহিমা খাতুন কে অভিনন্দন

Ev depolama Ucuz nakliyat teensexonline.com

খড়মপুরের ওরশ : কিছু কথা

Update Time : ১২:৪৩:১০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অগাস্ট ২০২৩

🔳এইচ.এম. সিরাজ🔳

❝ ছুটছে মানুষ দলে দলে নৌ সড়ক আর রেলে,
ভক্ত-বাউল-আশেকানের খড়মপুরের ডাক দিলে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় দরগাহ্ সৈয়দ কল্লাহ্ শাহ্’র,
সপ্তাহ জুড়েই চলবে ওরশ হবে গান জিকির-আযকার। ❞

♦খড়মপুর মাজারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস♦

ঐতিহ্যমণ্ডিত খড়মপুর। তিতাসপাড়ের এক পূণ্যভূমিও বটে। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের এই বাংলাদেশে আগমণকারী ৩৬০ আউলিয়ার মধ্যে ১২ জন ছিলেন শীর্ষতম। এই ১২ জনেরই একজন চিরশায়িত আছেন খড়মপুরে। আউলিয়ার এই দরগাহ্ তথা মাজার শরীফ’র জন্যই সমগ্র দেশবাসীর কাছে এমনকি পার্শ্ববর্তী কতেক দেশেও এই খড়মপুর অত্যন্ত সুপরিচিত। যার কারণে খড়মপুর দেশে-বিদেশে পরিচিত, তিনি হলেন হযরত শাহ্ পীর সৈয়দ আহাম্মদ গেছুদারাজ প্রকাশ্য শাহ্ পীর কল্লাহ্ শহীদ (রহ.)। এই দেশে আগমণকারী আউলিয়া সম্রাট হযরত শাহ্ জালাল ইয়ামেনী (রহ.) এর শিষ্যদের অন্যতম একজনও ছিলেন হযরত শাহ্ পীর সৈয়দ আহাম্মদ গেছুদারাজ (রহ.)। তিনিই বঙ্গ দেশে আগমণকারী শীর্ষতম ১২ আউলিয়ারও একজন, যে ১২ আউলিয়া নিয়ে বহু লোকজ কাহিনী আর ঐতিহ্য বিদ্যমান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সীমান্তবর্তী আখাউড়া উপজেলা সদরের তিতাস-সাইনধারা নদীর তীরবর্তী খড়মপুর গ্রামে অবস্থিত এই আউলিয়ার মাজার। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট রেলপথ এবং ঢাকা-আগরতলা সড়কপথ গমণ করেছে এই খড়মপুরেরই কোল ঘেষে। তাছাড়াও তিতাসপাড়ে অবস্থিত বিধায় নদীপথে এই খড়মপুরের মাজারে যাতায়াত করা অনেকটাই সহজতর। বিশেষত বর্ষাকালে দরগাহ্ ঘাটেই ভিড়ে ভক্ত-আশেকানদের নৌকা। এই সময়ে খড়মপুর দরগাহে দর্শনার্থীর আগমন ঘটে চোখে পড়ার মতো। সবকিছু মিলিয়ে বর্ষা মৌসুমে খড়মপুরে লোক সমাগম অনেকাংশেই বৃদ্ধি পায়। মাজারকে কেন্দ্র করে এ খড়মপুর তথা গোটা আখাউড়া উপজেলায় লেগেছে দৃশ্যমান পরিবর্তনের ছোঁয়া-ঘটেছে ব্যাপকতর উন্নতি। এখানকার জীবনমানের এমনকি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও অনেকটাই চোখে পড়ারই মতো এই মাজার তথা দরগাহকে ঘিরে। ঐতিহ্যবাহী এ মাজার ‘কেল্লা শহীদের দরগাহ্’ নামেও সমধিক পরিচিত।

খড়মপুরের দরগাহ্ সম্পর্কে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একটি লোকজ কাহিনী প্রচলিত আছে। যা লোকসঙ্গীত তথা বাউল সঙ্গীতের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে অতীব তাৎপর্যময়তার পাশাপাশি হয়ে ওঠেছে ইতিহাস এবং সাহিত্যেরও অংশ বিশেষ। আর তা হচ্ছে, তিতাসপাড়ের এই খড়মপুর গ্রামটিতে একদা ছিলো কৈবর্তদের (জেলে) সম্প্রদায়ের লোকদের বসবাস। একদিন চৈতন দাস ও তার সঙ্গীরা তিতাস নদীতে জাল ফেল মাছ ধরছিলেন। আচমকাই তাদের জালে একটি ‘খণ্ডিত শির’ আটকা পড়ে। এমনি অভাবনীয় দৃশ্য দেখে চৈতন দাসসহ উপস্থিত জেলেরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং খণ্ডিত শিরটিকে ওঠাতে গেলে আল্লাহ্’র কুদরতেই খণ্ডিত শির বলতে থাকে,- ❝ একজন আস্তিকের সাথে আরেক জন নাস্তিকের কখনোই কোনো প্রকারের মিল হতে পারে না। তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত পবিত্র কলেমা পাঠ করে মুসলমান না হবে, ঠিক ততোক্ষণ পর্যন্ত আমার মস্তক স্পর্শ করবে না। ❞

খণ্ডিত মস্তকের জবানে এমনি কথা শুনে মস্তকের কাছ থেকে কলেমা পাঠ করে চৈতন দাস ও তদীয় সঙ্গীরা তৎক্ষনাতই তাদের সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে যান। ধর্মান্তরিত হবার পর ওই জেলেদের নাম হয় শাহবলা, শাহলো, শাহজাদা, শাহগোরা ও শাহ রওশন। তাঁরাই খড়মপুর দরগাহের আদি বংশধর। তৎসময়ে মাত্র ২৮ ঘর বসতি ছিলো খড়মপুর গ্রামটিতে। আর তারা সকলেই ছিলেন কৈবর্ত সম্প্রদায়ের। তাদের প্রধান জীবিকা ছিলো গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী তিতাস নদীর বুকে জাল ফেলে মাছ আহরণ করা। উপরোক্ত ঘটনার পর ২৮ ঘর কৈবর্তের সকলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে শাহ্ উপাধি লাভ করেন। অপরদিকে মস্তকের নির্দেশনা মোতাবেক ইসলামী মতে খড়মপুর (তিতাস পাড়ে) কবরস্থানে মস্তক দাফন করা হয়। সেই থেকেই এটি শাহ্ পীর সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ প্রকাশ্য শাহ্ পীর কল্লাহ্ শহীদ’র (রহ.) মাজার নামে পরিচিতি লাভ করে। তিতাসপাড়ের ২৬০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত খড়মপুর দরগাহ্ শরীফের জায়গা ভারতবর্ষের আগরতলা রাজ্যের তদানীন্তন মহারাজা দান করেন।

বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেন যে, তরফ বিজয়ী আউলিয়া সম্রাট হযরত শাহ্ জালাল ইয়ামেনী (রহ.) এর নেতৃত্বে দিল্লী হয়ে বাংলায় ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে যে ৩৬০ জন আউলিয়া সিলেট এলাকায় এসেছিলেন হযরত সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ ছিলেন হযরত শাহ্ জালাল’র (রহ.) শিষ্যদের অন্যতম একজন। তদানীন্তন সময়ে গৌর গোবিন্দ ছিলেন তরফ রাজ্যের রাজা। ওই এলাকায় বোরহান উদ্দিন নামের একমাত্র মুসলমানের শিশুপুত্রকে গৌর গোবিন্দ রাজার লোকেরা কতল করে ফেলেন। অত্যাচারী ওই রাজার অনাচারকে থামাতে ৩৬০ আউলিয়া তরফ রাজ্যভূক্ত আজকের সিলেট জনপদে আগমণ করেন। খবর পেয়ে তাঁদের আগমণ ঠেকাতে রাজা গৌর গোবিন্দ সুরমা নদীর খেয়া পারাপার বন্ধ করে দেন। তখন হযরত শাহজালাল ইয়ামেনী (রহ.) নিজের জায়নামাজটিকে বিছিয়ে শিষ্যদের নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন সুরমা নদী। আউলিয়া সম্রাটের এমনি কেরামতিপূর্ণ ঘটনার পর রাজা গৌর গোবিন্দ পরাজয় থেকে নিজেকে রক্ষায় নতুন করে এক ফন্দি আঁটলেন।

রাজা গৌর গোবিন্দ তার আঁটা ফন্দি মোতাবেক রাজ্যের অনিন্দ সুন্দরী নারীদেরকে নগ্ন হয়ে সৈন্যদলের সামনে থাকার নির্দেশ দেন, যাতে মুসলমানেরা ঈমান হারাবার ভয়ে পিছু হটে যান। এমনি অবস্থায় হযরত শাহজালাল’র (রহ.) পরামর্শ মতে ওনার শিষ্য তথা সৈনিকেরাও অভিনব এবং কেরামতিপূর্ণ পন্থানুসরণ করেন। সকলেই পূর্ণ এখলাসের সাথে স্বীয় শিরকে আল্লাহ্’র হুকুমে ধর থেক সরে যেতে এবং যুদ্ধ শেষে স্বস্থানে ফিরে আসতে বললেন। একমাত্র সৈয়দ আহাম্মদ গেছুদারাজ তাঁর শিরকে ফিরে আসতে বলেন নি। হযরত শাহ্ জালাল’র (রহ.) প্রধান সেনাপতি হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (রহ.) পরিচালিত সংগঠিত যুদ্ধে রাজা গৌর গোবিন্দ পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। আর নিজের শিরকে ফিরে আসতে না বলায় ওই যুদ্ধে হযরত সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ (রহ.) শহীদ হয়েছিলেন এবং তাঁরই মস্তক পানিতে পড়ে স্রোতের সাথে ভাসতে ভাসতে তিতাস নদীর এই খড়মপুর এলাকায় এসে জেলেদের জালে আটকা পড়ে। আর এ সঙ্গতেই শাহ্ পীর সৈয়দ আহাম্মদ গেছুদারাজ (রহ.)’র মাজারকে প্রকাশ্য শাহ্ পীর কল্লাহ্ শহীদ (রহ.) এর মাজার কিংবা দরগাহ্ নামেও সমধিক পরিচিত।

ঐতিহ্যবাহী এই খড়মপুরস্থ ‘কেল্লা শহীদের দরগাহ্’-তে প্রতিবছর বাংলা শ্রাবণ মাসের ২৬ থেকে ০১ ভাদ্র মোতাবেক ১০-১৬ আগস্ট তারিখ পর্যন্ত সাত দিনব্যাপী বাৎসরিক ওরশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভক্ত-বাউল- আশেকান ছাড়াও লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে।
#
এইচ.এম. সিরাজ : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।