ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে,
কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে
বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে,
ভগবতী ভারতী দেবী নমোহস্তুতে।’
সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। অতএব সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী। সরস্বতী শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থে সরস+বতু আর স্ত্রী লিঙ্গে ‘ঈ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে সরস্বতী। তিনি বিদ্যাদেবী, জ্ঞানদায়িনী, বীণাপাণি, কুলপ্রিয়া, পলাশপ্রিয়া প্রভৃতি নামে অভিহিতা। তাঁর এক হাতে বীণা অন্য হাতে পুস্তক। প্রতি বছর মা সরস্বতী ধরণিতে আসেন আমাদের বিদ্যাবুদ্ধি দিতে, বিদ্যার ভান্ডারকে সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ করতে। বিদ্যার্থীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ১২টি মাস, ৩৬৫ দিন—কখন বিদ্যাদেবী আসবেন তাদের শিক্ষাঙ্গনে। সব শিক্ষার্থী একত্র হয়ে মাকে আগমন জানাতে শুরু করে প্রস্তুতি, সিদ্ধান্ত নেয় মা সরস্বতীকে পূজা দিতে এবারে কী কী আয়োজন থাকবে। প্রথমেই তারা দেবীর মূর্তি তৈরির জন্য নির্দিষ্ট কারিগরের কাছে চলে যায়, দেখেশুনে মূর্তি প্রাপ্তির তারিখ নিশ্চিত করে। তারপর শুরু হয় তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মহড়া; সেই সঙ্গে মণ্ডপ তৈরি, পুরোহিতকে সময়-তারিখ নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে আলপনা আঁকা আর মণ্ডপ সাজানোর কাজ চলতে থাকে। সরস্বতীপূজা দুর্গাপূজার মতোই সর্বজনীন পূজা। দলমত-নির্বিশেষে আবালবৃদ্ধবনিতা সরস্বতীপূজায় শরিক হয়। মায়ের কাছে বিদ্যা চাইতে সবাই জোড় হাত তুলে প্রণাম করে। মা তো বিদ্যার দেবী, তাই তাঁর কাছেই বিদ্যা চাইবে সবাই। বিদ্যা যদি না পাই, তবে তো পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারব না। একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে হলে বিদ্যার বিকল্প নেই। আচার-আচরণ, স্বভাব-প্রকৃতি সবকিছুই পরিপূর্ণতা পায় বিদ্যার গুণে। তাই বিদ্যার দেবীকে অঞ্জলির মাধ্যমে নিবেদন করে শিক্ষার্থীরা—তাদের মনস্কামনা যেন দেবী সরস্বতী পূরণ করেন, এই প্রার্থনাই পূজার মূলমন্ত্র। বাঙালির ঘরে ঘরে যে পূজা আবহমান কাল থেকে হয়ে আসছে, তা হচ্ছে সরস্বতীপূজা। দেবী সরস্বতী বিদ্যার দেবী, তাই শিক্ষার্থীদের জন্য আসেন বিদ্যার স্বরূপ হয়ে। বিদ্যা-বুদ্ধিতে সন্তানেরা সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে মায়ের আশীর্বাদে, এই দিন তাই সকালে পূজার আয়োজন চলে ঘরে ঘরে। অঞ্জলি আর প্রসাদ বিতরণের মধ্য দিয়ে পূজার মণ্ডপ হয়ে ওঠে আনন্দ-উৎসবে মুখর। মা দেবী সরস্বতী আমাদের বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান আর সুরের মূর্ছনায় ভরিয়ে দিতে আসেন প্রতি মাঘে। শীতের এই কুয়াশাঢাকা সকালে স্নান করে বই, খাতা, কলম নিয়ে মা দেবী সরস্বতীর কাছে আমরা হাজির হই পুষ্পাঞ্জলি দিতে। কারণ, মাকে আমার ভক্তি নিবেদন করতে হবে। কেননা বিদ্যা, বুদ্ধি আমার চাই। কথায় বলে, শিক্ষার শেষ নেই। আমার যতই ডিগ্রি থাকুক আর পদবি থাকুক, জানার যেমন শেষ নেই, তেমনি আমার বিদ্যাকে, আমার বুদ্ধিকে আরও আমি বাড়াতে চাই। তাই বলে বিদ্যার জাহাজ হওয়ার জন্য নয়। বিদ্যার একটি ছোট ডিঙি তো হতে পারি! সরস্বতীপূজাতে শিক্ষাঙ্গনের শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, তাদের সঙ্গে মিলিত হন সব শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী। সবাই মিলেই পূজাকে সার্থক ও পরিপূর্ণভাবে উদ্যাপন করে। অঞ্জলি আর দেবীর প্রসাদ বিতরণের পর শুরু হয় যজ্ঞ, তারপর ভোগ। সবাই আমন্ত্রিত হয়ে আসে পূজামণ্ডপ দর্শন আর প্রসাদ গ্রহণ করতে। সবশেষে আরতি আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করে বাড়ি ফিরে যায় সবাই। বিদ্যাদেবী সরস্বতীপূজার দিন অঞ্জলি দিয়ে দেবীর কাছে প্রার্থনা করে, তাদের যেন বিদ্যাবুদ্ধি হয়, জীবনে তারা যেন শিক্ষিত হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে সংসার, সমাজ আর দেশসেবা দিয়ে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। সরস্বতীপূজা যে শুধু হিন্দুধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের নিয়েই হয় তা কিন্তু নয়, তাদের সঙ্গে ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ থাকে এ পূজার আকর্ষণীয় দিক। পূজামণ্ডপে ছেলেমেয়েদের সুন্দর সাজে সজ্জিত হয়ে গান, আরতি, অঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ, রঙিন সাজে ধূপধূনা আর ফুল দিয়ে অঞ্জলি দিতে দেখা যায়। এ দৃশ্য দেখলে মন আনন্দে ভরে যায়, কে হিন্দু, কে মুসলমান, কেই-বা খ্রিষ্টান—বোঝা কঠিন। এ যেন এক মিলনমেলা। তখনই সত্যিকারভাবে ফুটে ওঠে সেই চিত্র—‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। পূজার দিন লেখাপড়া একেবারেই নিষেধ থাকে। পূজার পরে দোয়াত-কলম পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রের পূজারও প্রচলন আছে। এ দিনেই অনেকের হাতেখড়ি দেওয়া হয়। পূজা শেষে অঞ্জলি দেওয়াটা খুব জনপ্রিয়। আর যেহেতু সরস্বতী বিদ্যার দেবী তাই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এ উৎসব অনেক বড় করে পালিত হয়। আর সেখানে দল বেঁধে অঞ্জলি দেয় শিক্ষার্থীরা। মানুষের ভেতরের পশুকে নিবৃত্ত করে জ্ঞান দান করেন বিদ্যার দেবী সরস্বতী। মা সরস্বতীর জ্ঞানের দেবী, বিদ্যার দেবী, ললিতকলার দেবী। কয়েক দিন ধরেই এ পূজাকে ঘিরে ছাত্রছাত্রীরা আনন্দিত। গতকাল রাতেই মূর্তি স্থাপন করে পূজার সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলসহ সারা বাংলাদেশর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এ দিনে সবাই মিলে খিঁচুড়ি, লাবড়া, লুচি ও অন্যান্য মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য, ফলমূল বিশেষত কূল খাওয়া হয়। আবার সন্ধ্যাবেলায় আরতি উৎসব এবং নাচে-গানে মেতে ওঠে সবাই। সনাতন ধর্মের এ অন্যতম ধর্মীয় উৎসব এবার আবার ফাল্গুনের প্রথম দিনে হওয়াতে বসন্তের বাসন্তী আমেজের সাথে ধর্মীয় উৎসবের আমেজ মিলেমিশে একাকার। মা সরস্বতী আমাদের আশীর্বাদ করছেন-জীবনকে শুভ্র ও পবিত্র রাখ। সত্যকে আঁকড়ে রাখ। মূল গ্রন্থের বাণী পালন কর। জীবন ছন্দময় কর। স্বচ্ছন্দে থাক।’ এ বিশ্বের সবাই মনের কলূষতা দূর করে জ্ঞানের আলোয় নিজেকে ও অন্যকে আলোকিত করুক মা সরস্বতীর কাছে এই প্রার্থনাই করি।
লেখক: অতিথি প্রভাষক, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি মহিলা কলেজ।