করোনা মহামারীর বিধি নিষেধে দুই বছর পর্যটক শুন্য সরাইলের মিনি কক্সবাজার আবারও ফিরেছে পুরনো চিত্রে। আগের মত নেই পুলিশি বাঁধা। নেই কোন জটিলতা। স্থানটি ফিরে পেয়েছে হারানো সৌন্দর্য। গত মঙ্গলবার ঈদ আনন্দে সেখানে ছিল পর্যটকদের ঢল। নানা বয়সের নারী পুরূষ যুবক যুবতী ও শিশুদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠেছিল হাওর বেষ্টিত ওই ধর্মতীর্থ এলাকা। সরাইল-নাসিরনগর সড়কের ধর্মতীর্থ এলাকার ওই দুই কিলোমিটার সড়কের সৌন্দর্য বারবার কাছে টানে ভ্রমণ পিপাষুদের। বর্ষা মৌসুমে পানির কলকাকলি আর টেউয়ের তোড়। এরপর হাওরের সোনালী ধান, সবুজ শ্যামল চিত্র ও আগুনের লেলিহান শিখার মত অস্তগামী সূর্য পর্যটকদের কাছে টানে বারবার। তাই শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নয়। আশপাশের অন্যান্য জেলার বিনোদন প্রেমি অনেক লোকজন ছুটে আসেন এখানে। সরজমিনে দেখা যায়, দিনটি ছিল মঙ্গলবার। ঈদ-উল-ফিতর-এর আনন্দে ভাসছিলেন সকলেই। সকালে নামাজের পরই শুরূ হয় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। ইচ্ছে থাকা সত্বেও সকালে লোকজন বের হতে পারেননি। সেই সময়ে ধর্মতীর্থ এলাকার আকাশি হাওর বেষ্টিত মিনি কক্সবাজার ছিল একেবারে ফাঁকা। ঘড়ির কাটায় সকাল ১০টা। হালকা বৃষ্টি উপেক্ষা করেই আসতে থাকেন পর্যটকরা। পুটিয়া ব্রীজের দুই দিকে পর্যটকরা ঘুরছেন। হাওরের আংশিক এলাকায় জোয়ারের পানি। সেখানে প্রস্তুত ইঞ্জিত চালিত নৌকা। পর্যকরা আসবেন। মনের আনন্দে নৌকায় করে পানিতে ঘুরবেন। সকাল ১১টায় শুরূ হয় মুষলধারে বৃষ্টি। পর্যটকদের প্রবল ইচ্ছা ও আগ্রহের কাছে হার মানে বৈশাখের বৃষ্টি। সরে আসেননি কেউ। বৃষ্টিতে ভিজেই গাড়ি থেকে নামতে থাকেন লোকজন। বেলা বাড়ার সাথে বাড়তে থাকে মানুষের উপস্থিতি। দুপুরের পর সূর্যের ওকিঝুঁকি। মাঝে মধ্যে সূর্যের হাঁসি। আছে হালকা ঠান্ডা বাতাস। সব মিলিয়ে চসমৎকার আবহাওয়া। বিকেল ৩ টার পর পাল্টে যেতে থাকে মিনি কক্সবাজারের চিত্র। রোদ্র উপেক্ষা করেই মিনি কক্সবাজার এলাকায় আসতে শুরূ করে পর্যটকরা। মানুষের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার। নম্বর বিহীন মটর বাইকের মেলা। এ ছাড়া অটোরিকশা, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, বিভিন্ন ধরণের প্রাইভেট গাড়িতে করে আসছেন লোকজন। নিষেধ থাকা সত্বেও পিকআপ ভ্যানে সাউন্ড বক্স বসিয়ে গেয়ে নেচে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে সেখানে হয়েছে কিশোর ও যুবকদের ২০-৩০ টি দল। বিকেল ৪টার পর সেখানে মানুষের ঢল নামে। পর্যটকদের মধ্যে রয়েছে স্কুল কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। সরকারি বেসরকারি চাকরিজীবী নারী পুরূষ। চিকিৎসক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, শিক্ষক, উকিল, সাংবাদিক সাহিত্যিকসহ ভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। রয়েছে মধ্যবিত্ত ও নিস্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরাও। খোলা আকাশের নীচে মুক্ত বাতাসে একটু প্রশান্তির জন্যই এখানে ছুটে আসেন তারা। এখানে কোন গাছ নেই। নেই ছায়া দেয়ার স্থায়ী কোন ব্যবস্থা। এরপরও ভ্রমণ পিপাষু লোকজন আসছেই। সড়কের পাশের ঝোঁপঝাঁড়ে বসে গল্প। কেউ বসছেন ব্লকের উপর। আবার সড়ক সংলগ্ন স্থানে দূর্বাঘাসের উপরে গোলাকৃতি বরে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। হাওর বা ফসলি যাওয়ার লিংক রোডেও (মাটির তৈরী কাঁচা রাস্তা) ছিল পর্যটবদের ভীড়। প্রেমিক প্রেমিকা অটোরিকশা, প্রাইভেটকার বা নিজের যে কোন ধরণের গাড়িতে বসেই সময় পাড় করছেন। অনেকে চলে যাচ্ছেন সড়কের দু’পাশের খোলা মাঠে। বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হাঁসছেন। দুলছেন। এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। মানুষের স্রোত এতই বেশী ছিল যে শেষ বিকেলে পুটিয়া ব্রীজের ১ কিলোমিটার দক্ষিণ পাশে সড়কের উপর পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শেহাবুর রহমানের নেতৃত্বে চেক পোষ্ট বসায় পুলিশ। শর্ত ছিল হেলমেট ছাড়া কোন মটরবাইক যেতে পারবে না। তবে বিধি নিষেধটি সকলের জন্য প্রযোজ্য হওয়ার কথা থাকলেও প্রয়োগ হয়েছে গুটি কয়েকজন আরোহীর উপর। মুখ চিনে ও দাপটের শব্দ প্রয়োগকারীদের হেলমেট না থাকলেও ছেড়ে দিয়েছেন। আর আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, দূর্বল নিরীহ কিছু লোকের বাইক আটকে দিয়েছেন পুলিশ। এতে করে অনেক লোকের ভোগান্তি আরো বেড়ে গেছে। বিধি বা আইনটি সকলের জন্য নয় কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে নীরব ছিলেন পুলিশ। স্থানীয় বাসিন্দা সাবেক যুবলীগ নেতা মো. আলী মিয়া ও ইটভাটার শ্রমিক ধর্মতীর্থ গ্রামের বাসিন্দা মো. মিছির আলী বলেন, আজকের লোক সমাগম গত ৮-১০ বছরের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছে। সরাইল প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. আইয়ুব খান বলেন, এক যুগেরও অধিক সময় পূর্ব থেকেই স্থানটি পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে সরাইল প্রেসক্লাবের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মাহবুব খান দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় ‘সরাইলের মিনি কক্সবাজার’ শিরোনামে একটি ফিচার লিখেছিলেন। সেই থেকে মিনি কক্সবাজার নামটি মিশে যায় স্থানটির সাথে। ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। স্থায়ী পর্যটন কেন্দ্র করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন সাবেক এমপি এড. জিয়াউল হক মৃধা। এখানে ঝড় বৃষ্টিতে আশ্রয়ের কোন স্থান নেই। সুপেয় পানি পান ও খাবারের ভাল ব্যবস্থা নেই। থাকার জন্য আবাসিক কোন হোটেল নেই। এমনকি একটি ওয়াশরূম পর্যন্ত নেই। কষ্ট এবং টেনশন নিয়ে এখানে ঘুরে বেড়ান পর্যটকরা। এভাবে চলতে পারে না। জায়গাটিকে ঘিরে পর্যটকরা বারবার সম্ভাবনাময় একটি শিল্পের ইঙ্গিত করছেন। আমাদেরকে সেটি কাজে লাগাতে হবে। স্থায়ী পর্যটন কেন্দ্র করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে কাজ করতে হবে।
মাহবুব খান বাবুল