ঢাকা ১২:৩৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
বিল্ডিং কোড আইন অমান্য করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকায় বাড়ি নির্মাণের অভিযোগ নবীনগরে অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও মহড়া অনুষ্ঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে যুবক নিহত তারাবী নামাজের টাকা নিয়ে সংর্ঘষ, আহত ১৫ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আ.লীগ নেতা শফিকুল ইসলাম ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঈদ উপলক্ষ্যে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা পেল ঈদ-পোশাক সরাইলে শহীদ পরিবারের পাশে এনসিপি’র যুগ্ম আহবায়ক আশরাফ উদ্দিন মাহদি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ডিপিএফ’র মাসিক সভা অনুষ্ঠিত শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে ফেসবুকে পোস্ট, এসিল্যান্ডকে অব্যাহতি বন্দিদের ইফতারে ব্যাতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারা কর্তৃপক্ষ

হ্যাপী আজও লজ্জা পায় ! – এইচ.এম. সিরাজ –

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৯:৪৫:৩৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ৮৯ বার পড়া হয়েছে

হ্যাপী আজও লজ্জা পায় !

আজকের জার্নাল অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

হ্যাপী আজও লজ্জা পায় !
🔳 এইচ.এম. সিরাজ 🔳

স্কুল পাশ দিয়ে তখনকে সবেমাত্রই কলেজে পদার্পণ করেছি। মনের খোলা আকাশে সদায়ই উড়ে বেড়ায় রঙিন ঘুড়ি। সবকিছুতেই যেনো বিশেষ ধরণের চাকচিক্যতা। যাকে বলে ‘চোখে রঙিন চশমা’। অন্যদিকে ‘অমুকের পুত কলেজ পড়ে’! নিকটজন এবং আত্মীয়-স্বজনদের মুখে এমনতর আনন্দ সম্বোধনে অনেকটা আমোদিত-ই হতাম। ছুটিতে গ্রামে গেলেই মায়ের কাছে জানতে পারতাম ভিন্নখানে বেড়াতে যাবার আহবানের কথা। আমার মামার বাড়ি এবং একমাত্র খালার বাড়ি নিজ গ্রামেই। তাই বেড়ানোর আসল মজা আমার কাছে অনেকটাই ছিলো ফিকে। এরপরও বেড়ানোর আনন্দ বলতে দুই বোনের বাড়ি। অপরদিকে এক বোনের বাড়ির গ্রামেই ফুফুর বাড়ি। ফলে ওই দুই গ্রাম ব্যতীত অন্য কোথাও আমার খুব একটা যাওয়াই হতো না। তাও আবার বেশিরভাগই যাওয়া হতো নেহায়েত পারিবারিক প্রয়োজনেই। তবে আমাদের বাড়িতে নিকটাত্মীয় এমনকি অনাত্মীয় পর্যায়ের কুটুমদেরও অবাদ বিচরণ থাকতো প্রায় বছরজুড়েই। একদা আমাকে ঘিরে আত্মীয় পরিবারের এক সদস্যের অম্ল-মধুর কাণ্ড আজও ভাবায়-পোড়ায়-ভোগায়।

পাহাড়ি লাল মাটি অধ্যুষিত জনপদ, জাতীয় ফল কাঁঠালের এলাকায় আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। অধুনা বিলুপ্ত আরেকটি উপাদেয় জিনিসের জন্যও আমার জন্মস্থান ছিলো বিখ্যাত। সেটি হচ্ছে- মিষ্টি স্বাদের লাল মুলা। স্থানীয়ভাবে যেটি ছিলো ‘বোম্বাই মুলা’ নামে সমধিক পরিচিত। গ্রীষ্মকালে কাঁঠাল আর শীতকালে লাল মুলা- এ দুয়ে মিলে আমাদের দিতো বিশেষ মর্যাদা। তাছাড়া পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত সব রকমের ফলমূল এমনিতেই হয়ে থাকে অধিক স্বাদের। মূলত: জাতীয় ফল কাঁঠাল এবং লাল মুলা সমতল তথা অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার মানুষের কাছে একটা সময় ছিলো চরম লোভনীয়। আর এজন্যই হয়তো আমাদের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন এমনকি অনাত্মীয় পর্যায়ের অনেক কুটুমদেরও জম্পেশ আনাগোনা থাকতো প্রায় গোটা বছরজুড়েই। তাছাড়া পাহাড়ি এলাকার বিস্তীর্ণ জনপদে ঘুরে বেড়ানোর জায়গাও ভীষণ অবারিত। অনেকেই বেড়াতে আসতেন একেবারে সদলবলে। এলেও আবার অবস্থান করতেন অন্তত সপ্তাহকাল। ফলে নিকটস্থ আত্মীয়-স্বজন পরিবারের প্রায় সকল সদস্যের সাথে দেখা-সাক্ষাত, সখ্যতা ছিলো অত্যন্ত নিবিড়।শৈশব-কৈশোর এবং তৎসংলগ্ন সময়কালের মধুর থেকে মধুরতা আজও আমায় তাড়া করে ফিরে, স্মৃতিতে হয়ে আছে ভাস্বর।

কোনো এক ডিসেম্বর মাসের শেষার্ধের কথা। সাপ্তাহিক ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। তদানীন্তনকালে বেশ চুটিয়েই সংগঠন করতাম। শিল্প-সাহিত্যের পাশাপাশি বহু সামাজিকতার যেনো একরকমের ঠিকা নিয়েছিলাম বললেও হয়তোবা অত্যুক্ত হবে না। সেবার বাড়িতে যাবার সময়ে সাথে নেয়া ব্যাগে অন্য সবকিছুর সাথে পরম যতনেই রাখা ছিলো একটি কার্ড। ইংরেজি নববর্ষ অত্যাসন্ন। সঙ্গত কারণেই পুরাতনকে বিদাই জানাতে এবং নতুনকে বরণে আয়োজনের খামতি রাখতে চাইবেন না কেউই। নতুন বছরকে উদযাপন করা হবে নানাবিধ আঙ্গীকে, বেশ ঘটা করেই। নববর্ষের এমনি একটি অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র হিসেবেই কার্ডটি পাওয়া। এনালগ সেকালে নানান উপাচারের কার্ডের ছিলো তুমুল সমাদর। তন্মধ্যে নামাঙ্কিত দাওয়াত কার্ড বা নিমন্ত্রণপত্রের কদরতো আরো অধিক। আর এজন্যই হয়তো ব্যাগে করে নেয়া দাওয়াত কার্ডের বদৌলতে আমার প্রাপ্ত বিড়ম্বনার মাত্রাটাও একটু বেশি-ই হয়েছিলো !

চকচকে কার্ডটার উপরে কেবলই ‘হ্যাপী নিউ ইয়ার’ লিখা ছিলো। এছাড়া আর কিচ্ছুটিই নয়। অবশ্য ভেতরে সবকিছুই সবিস্তারে লিপিবদ্ধ। এদিকে ঠিক আগেরদিনই আমাদের বাড়িতে জনৈকা আত্মীয়া বেড়াতে এসেছিলেন ওনার প্রায় সোমত্ত দুই মেয়েকে নিয়ে। একটি কথা না বললেই নয়, তিনার বড় মেয়েটি আবার আমার ব্যাপারে ছিলো… যাকে সোজা বাংলায় বলে ‘তলে তলে তালতলাগামী’। বিষয়টি অতীব গোপনীয় এবং কনফিডেনসিয়াল হলেও তার পিঠাপিঠি ছোট বোনটি কিন্তু বিষয়টি ঠিক-ঠিকই জানতো। কারণ, এসবের অনুঘটকের ভূমিকা পালনকারী সে ছাড়া আর কেউই নয়। সে যাই হোক, সত্যিকারার্থেই অবকাশকালীন সময়ে আমাদের বাড়িতে তাদের বেড়াতে আসা এবং ঠিক একই সময়ে শহর থেকে আমার বাড়ি যাওয়াটা যেনো ‘ওর’ কাছে ছিলো অনেকটাই ‘বসন্ত বাতাস’। যদিও তখনকে ইংরেজি ডিসেম্বর মাস, প্রকৃতি তখনও শিতের বুড়ির দখলে। বসন্ত আগমণের ম্যালা সময় বাকি থাকলেও তার মনে বসন্তের দোলা লাগাটা এক্কেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার বটে।

আমি বরাবরই ছিলেম অনেকটা বাউণ্ডুলে প্রকৃতির। ঘর-বাইর সবকিছুই আমার কাছে ছিলো প্রায় একাকার। অবশ্য এখনও খুব একটা বদলে গেছি, এমনটাও নয় কিন্তু। সেবার সাপ্তাহিক ছুটিতে গ্রামে গিয়ে বাড়িতে ঢুকে যথারীতি সাথের ব্যাগটাকে কোনোরকমে ঘরে রেখেই বেড়িয়ে গেলাম। এবাড়ি থেকে ওবাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছিলাম নেহায়েতই আনমনে। গ্রাম, গ্রামের মানুষকে ফেলে শহরে থাকতে গিয়ে যেনো হাপিয়ে ওঠতাম কিংবা ম্যালা দিন পর নিকটজনদের কাছে পেয়ে আনন্দে একরকম আত্মহারা হয়ে ওঠতাম। পুরো গ্রামময় একটা চক্কর দেয়া শেষ হবার আগ পর্যন্ত অনেকটা বলগাহীন ঘোড়ার ন্যায় ছুটে বেড়াতাম। অপরদিকে সিমাহীন কৌতুহলী হবার কারণেই আমার ব্যাগ হাতড়াতে গিয়ে ‘ওর’ দৃষ্টি পড়লো সেই কার্ডটিতে। যাকে বলে,- ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়’ আরকি। প্রথম শব্দটা দেখেই সে যেনো হলো বজ্রাহত! কারণ সবে সাত ক্লাশে পাঠরত ওর ছোটবোনটির নামটি যে ছিলো ‘হ্যাপী’। আর কার্ডেও লিখা ‘হ্যাপী…….!’ সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলো না যে, আমি তারই ছোট বোনের————————–!

শেষতক ওর বেসুমার চাপাচাপিতেই হ্যাপীসমেত ওর মাকে বেড়ানোতে ইস্তফা দিতেই হয়। বাড়ি যেতে যেতে বিনা কারণে হ্যাপীকে তিন-তিনবার বড়বোনের মার পর্যন্ত হজম করতে হয়। ছ’মাস পর পরিবারের পছন্দে ওর বিয়ের সময় হ্যাপীকে পুরো বিষয়টিই সে খুলে বলেছিলো। বোনের কাছ থেকে পুরো বাষয়টি শুনে হ্যাপী তখন দারুণ লজ্জা পায়, এমনকি ভীষণ কষ্টও। কারণ আমার প্রতি ওর আসক্তির বিষয়টা হ্যাপী বেশ ভালোমতোই জানতো। কেননা, হ্যাপীর মাধ্যমেই তো সে প্রথমবার বিষয়টি আমাকে করেছিলো অবহিত।জবাবে আমি হ্যাপীর মাধ্যমে এমনকি নিজে সরাসরিও তাকে পড়ালেখায় মনোযোগী হতেই বলেছিলাম। আমার ওই ‘পড়ালেখায় মনোযোগী হও’ কথাটিকেই সে সম্পূর্ণ ‘পজেটিভ’ ভেবে নেয়। অর্থাৎ আমি তার প্রস্তাব একেবারে ষোলআনা-ই মেনে নিয়েছি, আমি তারই হবো; এমনকি হয়েই গেছি- এরকমটাই ছিলো তার হিসেব। অপরদিকে তার পিঠাপিঠি ছোট বোন হ্যাপীও এক্কেবারে মনেপ্রাণেই আমাকে মনে করতো তার বোনের হবু————————————!

একজন নারী আরেকজন নারীকে সর্বদায়ই নিজের প্রতিপক্ষ জ্ঞান করে, সে হোক তার মাতৃ জঠরজাত বোন কিংবা অন্য যে কেউ। এটা একরকম চিরন্তন সত্যও বটে।যেই ছোট বোনের মাধ্যমে নিজের মনের কথা আমায় বলেছিলো, সেই হ্যাপীকেই প্রতিপক্ষ ভেবেছিলো তার-ই বড় বোন! আর এহেন মনগড়া বিশ্বাসের প্রেক্ষিতে সেদিনের মজার বেড়ানোটা করেছিলো এক্কেবারে বরবাদ! উল্টো ছোট বোন হ্যাপীকে মেরেওছিলো তিন-তিনবার। মিছিমিছি মনগড়া ভাবনা ভেবে আমাকে নিয়ে দু’বোনেরই আশায় গুড়ে বালি দিলো। অথচ ‘হ্যাপী নিউ ইয়ার’ খচিত কার্ডটা যে স্রেফ নববর্ষের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র ছিলো সেইটিও বুঝতে চায়নি, এমনকি পড়েও দেখেনি। হ্যাপী আজও বিষয়টি নিয়ে লজ্জা পায় এবং দারুণ মজাও করে। এইতো সেদিন, হ্যাপী তার ছেলের পরীক্ষার ফলাফলের খবর জানানোকালেও এমনটাই বললো।

পাদটিকা:
হয়তোবা এই কারণেই কীনা, আমি আজও কাউকেই ‘হ্যাপী নিউ ইয়ার’ খুব একটা জানাতে পারি না!
#
এইচ.এম. সিরাজ : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।
ই-মেইল : serajhm@gmail.com

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

হ্যাপী আজও লজ্জা পায় ! – এইচ.এম. সিরাজ –

আপডেট সময় : ০৯:৪৫:৩৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

হ্যাপী আজও লজ্জা পায় !
🔳 এইচ.এম. সিরাজ 🔳

স্কুল পাশ দিয়ে তখনকে সবেমাত্রই কলেজে পদার্পণ করেছি। মনের খোলা আকাশে সদায়ই উড়ে বেড়ায় রঙিন ঘুড়ি। সবকিছুতেই যেনো বিশেষ ধরণের চাকচিক্যতা। যাকে বলে ‘চোখে রঙিন চশমা’। অন্যদিকে ‘অমুকের পুত কলেজ পড়ে’! নিকটজন এবং আত্মীয়-স্বজনদের মুখে এমনতর আনন্দ সম্বোধনে অনেকটা আমোদিত-ই হতাম। ছুটিতে গ্রামে গেলেই মায়ের কাছে জানতে পারতাম ভিন্নখানে বেড়াতে যাবার আহবানের কথা। আমার মামার বাড়ি এবং একমাত্র খালার বাড়ি নিজ গ্রামেই। তাই বেড়ানোর আসল মজা আমার কাছে অনেকটাই ছিলো ফিকে। এরপরও বেড়ানোর আনন্দ বলতে দুই বোনের বাড়ি। অপরদিকে এক বোনের বাড়ির গ্রামেই ফুফুর বাড়ি। ফলে ওই দুই গ্রাম ব্যতীত অন্য কোথাও আমার খুব একটা যাওয়াই হতো না। তাও আবার বেশিরভাগই যাওয়া হতো নেহায়েত পারিবারিক প্রয়োজনেই। তবে আমাদের বাড়িতে নিকটাত্মীয় এমনকি অনাত্মীয় পর্যায়ের কুটুমদেরও অবাদ বিচরণ থাকতো প্রায় বছরজুড়েই। একদা আমাকে ঘিরে আত্মীয় পরিবারের এক সদস্যের অম্ল-মধুর কাণ্ড আজও ভাবায়-পোড়ায়-ভোগায়।

পাহাড়ি লাল মাটি অধ্যুষিত জনপদ, জাতীয় ফল কাঁঠালের এলাকায় আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। অধুনা বিলুপ্ত আরেকটি উপাদেয় জিনিসের জন্যও আমার জন্মস্থান ছিলো বিখ্যাত। সেটি হচ্ছে- মিষ্টি স্বাদের লাল মুলা। স্থানীয়ভাবে যেটি ছিলো ‘বোম্বাই মুলা’ নামে সমধিক পরিচিত। গ্রীষ্মকালে কাঁঠাল আর শীতকালে লাল মুলা- এ দুয়ে মিলে আমাদের দিতো বিশেষ মর্যাদা। তাছাড়া পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত সব রকমের ফলমূল এমনিতেই হয়ে থাকে অধিক স্বাদের। মূলত: জাতীয় ফল কাঁঠাল এবং লাল মুলা সমতল তথা অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার মানুষের কাছে একটা সময় ছিলো চরম লোভনীয়। আর এজন্যই হয়তো আমাদের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন এমনকি অনাত্মীয় পর্যায়ের অনেক কুটুমদেরও জম্পেশ আনাগোনা থাকতো প্রায় গোটা বছরজুড়েই। তাছাড়া পাহাড়ি এলাকার বিস্তীর্ণ জনপদে ঘুরে বেড়ানোর জায়গাও ভীষণ অবারিত। অনেকেই বেড়াতে আসতেন একেবারে সদলবলে। এলেও আবার অবস্থান করতেন অন্তত সপ্তাহকাল। ফলে নিকটস্থ আত্মীয়-স্বজন পরিবারের প্রায় সকল সদস্যের সাথে দেখা-সাক্ষাত, সখ্যতা ছিলো অত্যন্ত নিবিড়।শৈশব-কৈশোর এবং তৎসংলগ্ন সময়কালের মধুর থেকে মধুরতা আজও আমায় তাড়া করে ফিরে, স্মৃতিতে হয়ে আছে ভাস্বর।

কোনো এক ডিসেম্বর মাসের শেষার্ধের কথা। সাপ্তাহিক ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। তদানীন্তনকালে বেশ চুটিয়েই সংগঠন করতাম। শিল্প-সাহিত্যের পাশাপাশি বহু সামাজিকতার যেনো একরকমের ঠিকা নিয়েছিলাম বললেও হয়তোবা অত্যুক্ত হবে না। সেবার বাড়িতে যাবার সময়ে সাথে নেয়া ব্যাগে অন্য সবকিছুর সাথে পরম যতনেই রাখা ছিলো একটি কার্ড। ইংরেজি নববর্ষ অত্যাসন্ন। সঙ্গত কারণেই পুরাতনকে বিদাই জানাতে এবং নতুনকে বরণে আয়োজনের খামতি রাখতে চাইবেন না কেউই। নতুন বছরকে উদযাপন করা হবে নানাবিধ আঙ্গীকে, বেশ ঘটা করেই। নববর্ষের এমনি একটি অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র হিসেবেই কার্ডটি পাওয়া। এনালগ সেকালে নানান উপাচারের কার্ডের ছিলো তুমুল সমাদর। তন্মধ্যে নামাঙ্কিত দাওয়াত কার্ড বা নিমন্ত্রণপত্রের কদরতো আরো অধিক। আর এজন্যই হয়তো ব্যাগে করে নেয়া দাওয়াত কার্ডের বদৌলতে আমার প্রাপ্ত বিড়ম্বনার মাত্রাটাও একটু বেশি-ই হয়েছিলো !

চকচকে কার্ডটার উপরে কেবলই ‘হ্যাপী নিউ ইয়ার’ লিখা ছিলো। এছাড়া আর কিচ্ছুটিই নয়। অবশ্য ভেতরে সবকিছুই সবিস্তারে লিপিবদ্ধ। এদিকে ঠিক আগেরদিনই আমাদের বাড়িতে জনৈকা আত্মীয়া বেড়াতে এসেছিলেন ওনার প্রায় সোমত্ত দুই মেয়েকে নিয়ে। একটি কথা না বললেই নয়, তিনার বড় মেয়েটি আবার আমার ব্যাপারে ছিলো… যাকে সোজা বাংলায় বলে ‘তলে তলে তালতলাগামী’। বিষয়টি অতীব গোপনীয় এবং কনফিডেনসিয়াল হলেও তার পিঠাপিঠি ছোট বোনটি কিন্তু বিষয়টি ঠিক-ঠিকই জানতো। কারণ, এসবের অনুঘটকের ভূমিকা পালনকারী সে ছাড়া আর কেউই নয়। সে যাই হোক, সত্যিকারার্থেই অবকাশকালীন সময়ে আমাদের বাড়িতে তাদের বেড়াতে আসা এবং ঠিক একই সময়ে শহর থেকে আমার বাড়ি যাওয়াটা যেনো ‘ওর’ কাছে ছিলো অনেকটাই ‘বসন্ত বাতাস’। যদিও তখনকে ইংরেজি ডিসেম্বর মাস, প্রকৃতি তখনও শিতের বুড়ির দখলে। বসন্ত আগমণের ম্যালা সময় বাকি থাকলেও তার মনে বসন্তের দোলা লাগাটা এক্কেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার বটে।

আমি বরাবরই ছিলেম অনেকটা বাউণ্ডুলে প্রকৃতির। ঘর-বাইর সবকিছুই আমার কাছে ছিলো প্রায় একাকার। অবশ্য এখনও খুব একটা বদলে গেছি, এমনটাও নয় কিন্তু। সেবার সাপ্তাহিক ছুটিতে গ্রামে গিয়ে বাড়িতে ঢুকে যথারীতি সাথের ব্যাগটাকে কোনোরকমে ঘরে রেখেই বেড়িয়ে গেলাম। এবাড়ি থেকে ওবাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছিলাম নেহায়েতই আনমনে। গ্রাম, গ্রামের মানুষকে ফেলে শহরে থাকতে গিয়ে যেনো হাপিয়ে ওঠতাম কিংবা ম্যালা দিন পর নিকটজনদের কাছে পেয়ে আনন্দে একরকম আত্মহারা হয়ে ওঠতাম। পুরো গ্রামময় একটা চক্কর দেয়া শেষ হবার আগ পর্যন্ত অনেকটা বলগাহীন ঘোড়ার ন্যায় ছুটে বেড়াতাম। অপরদিকে সিমাহীন কৌতুহলী হবার কারণেই আমার ব্যাগ হাতড়াতে গিয়ে ‘ওর’ দৃষ্টি পড়লো সেই কার্ডটিতে। যাকে বলে,- ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়’ আরকি। প্রথম শব্দটা দেখেই সে যেনো হলো বজ্রাহত! কারণ সবে সাত ক্লাশে পাঠরত ওর ছোটবোনটির নামটি যে ছিলো ‘হ্যাপী’। আর কার্ডেও লিখা ‘হ্যাপী…….!’ সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলো না যে, আমি তারই ছোট বোনের————————–!

শেষতক ওর বেসুমার চাপাচাপিতেই হ্যাপীসমেত ওর মাকে বেড়ানোতে ইস্তফা দিতেই হয়। বাড়ি যেতে যেতে বিনা কারণে হ্যাপীকে তিন-তিনবার বড়বোনের মার পর্যন্ত হজম করতে হয়। ছ’মাস পর পরিবারের পছন্দে ওর বিয়ের সময় হ্যাপীকে পুরো বিষয়টিই সে খুলে বলেছিলো। বোনের কাছ থেকে পুরো বাষয়টি শুনে হ্যাপী তখন দারুণ লজ্জা পায়, এমনকি ভীষণ কষ্টও। কারণ আমার প্রতি ওর আসক্তির বিষয়টা হ্যাপী বেশ ভালোমতোই জানতো। কেননা, হ্যাপীর মাধ্যমেই তো সে প্রথমবার বিষয়টি আমাকে করেছিলো অবহিত।জবাবে আমি হ্যাপীর মাধ্যমে এমনকি নিজে সরাসরিও তাকে পড়ালেখায় মনোযোগী হতেই বলেছিলাম। আমার ওই ‘পড়ালেখায় মনোযোগী হও’ কথাটিকেই সে সম্পূর্ণ ‘পজেটিভ’ ভেবে নেয়। অর্থাৎ আমি তার প্রস্তাব একেবারে ষোলআনা-ই মেনে নিয়েছি, আমি তারই হবো; এমনকি হয়েই গেছি- এরকমটাই ছিলো তার হিসেব। অপরদিকে তার পিঠাপিঠি ছোট বোন হ্যাপীও এক্কেবারে মনেপ্রাণেই আমাকে মনে করতো তার বোনের হবু————————————!

একজন নারী আরেকজন নারীকে সর্বদায়ই নিজের প্রতিপক্ষ জ্ঞান করে, সে হোক তার মাতৃ জঠরজাত বোন কিংবা অন্য যে কেউ। এটা একরকম চিরন্তন সত্যও বটে।যেই ছোট বোনের মাধ্যমে নিজের মনের কথা আমায় বলেছিলো, সেই হ্যাপীকেই প্রতিপক্ষ ভেবেছিলো তার-ই বড় বোন! আর এহেন মনগড়া বিশ্বাসের প্রেক্ষিতে সেদিনের মজার বেড়ানোটা করেছিলো এক্কেবারে বরবাদ! উল্টো ছোট বোন হ্যাপীকে মেরেওছিলো তিন-তিনবার। মিছিমিছি মনগড়া ভাবনা ভেবে আমাকে নিয়ে দু’বোনেরই আশায় গুড়ে বালি দিলো। অথচ ‘হ্যাপী নিউ ইয়ার’ খচিত কার্ডটা যে স্রেফ নববর্ষের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র ছিলো সেইটিও বুঝতে চায়নি, এমনকি পড়েও দেখেনি। হ্যাপী আজও বিষয়টি নিয়ে লজ্জা পায় এবং দারুণ মজাও করে। এইতো সেদিন, হ্যাপী তার ছেলের পরীক্ষার ফলাফলের খবর জানানোকালেও এমনটাই বললো।

পাদটিকা:
হয়তোবা এই কারণেই কীনা, আমি আজও কাউকেই ‘হ্যাপী নিউ ইয়ার’ খুব একটা জানাতে পারি না!
#
এইচ.এম. সিরাজ : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।
ই-মেইল : serajhm@gmail.com