মাহবুব খান বাবুলঃ সরাইল থেকেঃ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ ইউনিয়নের ‘ধর্মতীর্থ গণহত্যা দিবস’ পালিত হয়েছে। দিবসটি পালন উপলক্ষ্যে আজ বুধবার ১৮ অক্টোবর বিকেলে সেখানকার বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন উপজেলা পরিষদের পক্ষে ভাইস চেয়ারম্যান আবু হানিফ, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাছরিন সুলতানা, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সহিদ খালিদ জামিল খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট আব্দুর রাশেদ ও মো. নান্নু মিয়া।
সূত্র জানায়, ১৯৭১ সালের ১৮ অক্টোবর ধর্মতীর্থ এলাকায় বর্বর পাকিস্তানি সেনা, রাজাকারসহ তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা উপজেলার চুন্টা ও কালীকচ্ছ ইউনিয়নের শতাধিক নারী-পুরূষকে একত্র করে (যার অধিকাংশ সংখ্যালঘু) নির্যাতন করে গণহত্যা করে। এটি ধর্মতীর্থ গণগত্যা নামে পরিচিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা ও ধর্মতীর্থ গ্রামের বাসিন্ধা আব্দুর রশিদ (৬৭) স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, সাইনবোর্ড দেয়া জায়গাটিতেই লাইন ধরিয়ে নির্মমভাবে মানুষ গুলোকে হত্যা করেছে। আমি নিজ হাতে লাশ টেনেছি। বীর মক্তিযোদ্ধা মো. নান্নু মিয়া ও অহিদ মিয়া বলেন, আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশের এ বধ্যভূমির সৌন্দর্য বর্ধন ও স্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা জরূরী। এ জন্য আমরা জাতিরজনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জেলা প্রশাসকের জরূরী হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এক দল মুক্তিযোদ্ধা মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উপজেলার কালীকচ্ছ ধর্মতীর্থ এলাকায় স্থানীয় রাজাকার প্রধান, সরাইল থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মুসলীম লীগ নেতা আবদুল মন্নাফ ঠাকুর ও তাঁর দোসর বর্বর পাকিস্থানি সেনা কর্মকর্তা (ক্যাপ্টেন) এ রহমান খানসহ কয়েকজন পাকসেনাকে হত্যা করে। যুদ্ধকালীন সরাইল থানা মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ কমান্ডার আবদুল্লাহ ভূইয়া বলেন, ‘আবদুল মন্নাফ ঠাকুর নিহত হওয়ার পর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন তার জামাতা (ঘরজামাই) ফয়েজুর রহমান ওপফে সেলুর বাপ। তখন সেলুর বাপ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েক করে। ৬ অক্টোবরের ঘটনার প্রতিশোধ নিতে সেলুর বাপের নেতৃত্বে ১৮ অক্টোবর ধর্মতীর্থ এলাকায় গণহত্যা চালায় পাক সেনারা। ওই দিন শতাধিক নরনারীকে (যার অধিকাংশ সংখ্যালঘু) হত্যা করা হয়।’ এটি ধর্মতীর্থ গণগত্যা নামে পরিচিত।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সরাইল উপজেলার সেই বধ্যভূমিটি সংরক্ষেণের জন্য প্রথম সাইনবোর্ড স্থাপন করা। এটি সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ ইউনিয়নের ধর্মতীর্থ নৌঘাটে অবস্থিত। এখানে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হওয়া ৪৬ জনের তালিকাযুক্ত একটি নামফলক ছিল। ২০২০ সালের ১০ জুলাই সন্ধ্যায় ওই বধ্যভূমি থেকে দুর্বত্তরা সেই নামফলকটি উধাও করে দেয়। এ নিয়ে ‘বধ্যভূমি থেকে উধাও শহীদদের নামফলক’ শিরোনামে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় একাধিক সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর পর নড়ে চড়ে বসে প্রশাসন। ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর প্রশাসনের পক্ষ থেকে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ এস এম মোসা বধ্যভূমির ঠিক মাঝখানে একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করেন। যাতে লেখা রয়েছে ‘১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যার স্মৃতি বিজড়িত স্থান। এই স্থানের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য অনুরোধ করা হইল।’ এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বুধবার ওই বধ্যভূমিতে উপজেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধারা ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।