মাহবুব খান বাবুল, সরাইল থেকেঃ
মায়ের ভাষা আমাদের অধিকার। আর এই অধিকার আদায়ের পেছনে রয়েছে আত্মত্যাগের করূন ইতিহাস। ইতিহাসটি রচিত হয়েছিল ১৯৫২ সালে। ভাষার শহীদদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল ৫২ সালের ২৩ ফেব্রূয়ারি। প্রতি বছর ২১ ফেব্রূয়ারি শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে আমাদের সেই গৌরবগাঁথা ইতিহাসকে স্বরণ করি। গর্ববোধও করি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর শহিদ মিনার ও ফুল আমাদের নতুন প্রজন্মকে ভাষার ইতিহাস জানতে সহায়তা করে। দেশপ্রেম ও মাতৃভাষার প্রতি উদ্ভুদ্ধ করে। মায়ের ভাষা কেড়ে নেয়ার হীন ষড়যন্ত্রের প্রতি ঘৃণা জন্মায়। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ভাষা ও দেশের গান শুনে শিক্ষার্থীদের রক্ত শিউরে ওঠে। তাই প্রাথমিক থেকে শুরূ করে কলেজ পর্যন্ত শহিদ মিনার নির্মাণ করা খুবই জরূরী ও গুরূত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ সরাইল উপজেলার ২ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আদৌ নির্মিত হয়নি শহিদ মিনার। ভাষা আন্দোলনে জয়লাভের ৭১ বছর পরও আমাদের সামনে উঠে আসছে শহিদ মিনার নির্মাণ করতে না পারার ব্যর্থতা। এটা শুধু ব্যর্থতাই নয়, লজ্জারও। এর ফলে নতুন প্রজন্ম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও অর্জনের জ্ঞানার্জন থেকে বঞ্ছিত হচ্ছে। তাই জাতীয় ওই দিবসটির দায় সারতে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরা কলাগাছ, কাঠ, বাঁশ, মলিবাঁশ, গাছের ডালপালা, ইটাবালি ও কাগজের উপর ভরসা করেই পার দিয়েছেন ৭১ বছর। অথচ ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার নির্মাণের আদেশ দিয়েছিল উচ্চ আদালত। প্রয়োজনে নিজেদের উদ্যোগে মাধ্যমিক বিদ্যালয় সমূহে শহিদ মিনার নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছিলেন মাউশি। কিন’ তা বাস্তবায়ন হয়নি আদৌ।
সরজমিন অনুসন্ধান, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, সরাইল উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে ১২৬ টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১০৮টি কিন্ডার গার্টেন, ২৬ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৪টি কলেজ রয়েছে। এরমধ্যে ১০৬ টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, ১০৬ টি কিন্ডার গার্টেনে, ১১ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২টি মাদ্রাসা ও ২ টি কলেজে নেই শহিদ মিনার। উপজেলার মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২৬২ টি। শহিদ মিনার নেই ২২৫ টিতে। এই উপজেলায় শহিদ মিনার নেই ৮৬ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সরাইল উপজেলা পরিষদ চত্বরে ও প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সংলগ্ন স’ানে ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত নিজসরাইল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়েই নেই শহিদ মিনার। এ ছাড়া সরাইল সদর উচ্চ বিদ্যালয়েও সরাইল সদরের সরাইল মডেল, বড্ডাপাড়া, উচালিয়াপাড়া, বড়বাড়ি, জিলুকদার পাড়া, সরাইল সদর উচ্চ বিদ্যালয়, স্বল্প নোয়াগাঁও, কুট্রাপাড়া পশ্চিম ও কুট্রাপাড়া পূর্ব সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আদৌ নির্মিত হয়নি শহিদ মিনার। শহিদ মিনার সরাইল সবচেয়ে পুরাতন (১৮৮৫ খ্রি. স’াপিত) কালিকচ্ছ দক্ষিণ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
এ ছাড়া কাকরিয়া, ধামাউড়া, অরূয়াইল, বারপাইকা, পরমানন্দপুর, পাকশিমুল, ষাটবাড়িয়া, জয়ধরকান্দি পূর্ব, জয়ধরকান্দি পশ্চিম, ব্রাহ্মণগাঁও, চুন্টা পুরাতন, চুন্টা দক্ষিণ, আজবপুর, বড়বল্লা, দেওবাড়িয়া, চানপুর, ধর্মতীর্থ, কালিকচ্ছ পশ্চিম, কালিকচ্ছ দক্ষিণ, সূর্যকান্দি, নোয়াগাঁও পশ্চিম, নোয়াগাঁও পূর্ব, আঁখিতারা, চানপুর নতুন, তেরকান্দা, রসুলপুর উত্তর, রসুলপুর দক্ষিণ, গুনারা, টিঘর, সৈয়দটুলা দক্ষিণ, সৈয়দটুলা উত্তর, বিটঘর, বড়ইবাড়ি, কানিখাই, কুট্রাপাড়া দক্ষিণ, মহালদারা, বারিউড়া, আইরল, কুচনী, বুড্ডা, ক্ষমতাপুর, শাহবাজপুর উত্তর, শাহবাজপুর পূর্ব, শাহবাজপুর পশ্চিম, ধীতপুর, দেওড়া পূর্ব, দেওড়া পশ্চিম, শাহজাদাপুর উত্তর, শাহজাদাপুর পশ্চিম, শাহজাদাপুর পূর্ব, নিয়ামতপুর, ধামাউড়া, দুবাজাইল পশ্চিম, বাদে অরূয়াইল, শোলাকান্দি মহিম, করিমপুর, জয়ধরকান্দি পশ্চিম, পাকশিমুল দক্ষিণ, কালিশিমুল উত্তর, কালিশিমুল পূর্ব, ভূঁইশ্বর, পরমানন্দপুর পশ্চিম, বালিয়াকান্দি, হরিপুর, লোপাড়া দক্ষিণ, নরসিংহপুর রাঙ্গুরীপাড়া, মোবারক হোসেন, ঘাগড়াজুর উত্তর, ঘাগড়াজুর দক্ষিণ, বড়াইল, করাতকান্দি, রসুলপুর পশ্চিম, রসুলপুর পশ্চিমপাড়া, গলানিয়া, চাকসার, টিঘর পূর্ব, শাখাইতি আকবরপাড়া, নাইলা, বিটঘর পূর্ব, সিতাহরণ, সৈয়দটুলা পশ্চিম, কাজীউড়া, নোয়াগাঁও মধ্যপাড়া, তিয়োরকোনা, কাটানিশার, কানিউচ্চ, বছিউড়া, শাহবাজপুর দিঘীরপাড়, লতিফ মোস্তারী, ভৈষামুড়া, ধাউরিয়া, মলাইশ উত্তর, গাজীপুর, দেওড়া দক্ষিণ, চানপুর (নতুন), চর কাকরিয়া নিরাজ আলী ও তেলিকান্দি দক্ষিণ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই শহিদ মিনার। উল্লেখিত অধিকাংশ বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জাতীয় দিবসে উপজেলা সদরের কর্মসূচিতে অংশ গ্রহন করতে পারছে না। কিছু বিদ্যালয় শহিদ দিবসে বাঁশ, মলিবাঁশ, কলাগাছ, ইটাবালি ও ডালপালা দিয়ে কোন রকমে শহিদ মিনার নির্মাণ করে ফুল দিয়ে দায় সারলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই হচ্ছে বঞ্ছিত।
ফলে জাতী সত্তার সাথে জড়িত এমন গুরূত্বপূর্ণ দিবসের মর্যাদা ও মর্মার্থ অজানাই থেকে যাচ্ছে তাদের। কারণ শিশু ভাষা শিক্ষা শুরূ করে মায়ের মুখ থেকে শুনে। প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা শিক্ষা শুরূ হয় প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পর। বাড়িতে বর্ণমালার প্রাথমিক পরিচয় সম্পন্ন হয়। প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তি হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক ভাবে শিশুর শিখন পক্রিয়া শুরূ হয়। বর্ণের ব্যবহার, শব্দ তৈরী, শব্দ থেকে বাক্য তৈরী ও বাংলা ভাষার মাধুর্যতার সাথে ক্রমেই শিশুর পরিচিতি ঘটতে থাকে। এখান থেকেই ভাষার প্রতি শিশুর দায়িত্ব ও মমত্ববোধ তৈরী হয়। এর ফলে আন্তরিকতার সাথে প্রতি বছর ২১ শে ফেব্রূয়ারি ভাষা শহিদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা অংশ গ্রহন করে। কিন’ সরাইলে ৮৬ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার না থাকায় ভাষা দিবসের ইতিহাস তাৎপর্য ও গুরূত্ব জানা থেকে বঞ্ছিত হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার থাকলে ভাষার প্রতি যে প্রেম ভালোবাসা শিশুরা অনুধাবন করতে পারতো। তা কিন’ হচ্ছে না। ছোট ছেলে মেয়েরা বাঁশ, কাঠ ও কলাগাছ দিয়েও শহিদ মিনার তৈরী করে ফুল দিতে দেখা যায়। নিজ উদ্যোগেই তারা মহান এই কাজটি করে। কত কিছুই তো হচ্ছে। তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেন ৭১ বছর পরও শহিদ মিনার থাকবে না? মনে রাখতে হবে আমাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে ভাষার মাধ্যমেই। পৃথিবীর আলো দেখার পর মা ও আশাপাশের লোকজনের মুখে নানা ভাষা শুনে শিশুরা ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। আর সেটাই হচ্ছে মাতৃভাষা। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি শহিদ মিনার থাকার অর্থ হলো শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন উপসি’ত হয়ে শহিদ মিনার দেখবে। এতে শিশুর মনে দায়িত্ববোধের জন্ম নিবে। বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে আরো উচুঁতে পৌঁছে দিতে এ প্রজন্মই হাল ধরবে। সূত্র জানায়, ইচ্ছে করলে ব্যক্তি উদ্যোগেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহে শহিদ মিনার নির্মাণ করা যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলো গত ১৩ বছর ধরে স্লিপ ও সংস্কার বাবদ লাখ লাখ টাকা বরাদ্ধ পাচ্ছেন। এক সময় এসব টাকা লুটপাটের খবরও জাতীয় ও স’ানীয় পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে।
ওই টাকার একটা অংশ খরচ করলেই তো প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে এতদিনে শহিদ মিনার নির্মাণ হয়ে যেত। নতুন ভবনের ইষ্টিমিটে শহিদ মিনার নির্মাণ ব্যয়ও যুক্ত করতে পারতেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স’ানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, অনেক বিদ্যালয়ের প্রধান, এসএমসি’র সভাপতি ও সদস্যরা শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে সম্মান করাকে ভিন্ন চোখে দেখেন। চাকরী রক্ষার্থে তারা দিবসটি পালনে কাজ করে থাকেন। উনারা অনেকটা ইচ্ছা করেই বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার নির্মাণ করছেন না। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নৌশাদ মাহমুদ ১০৬ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার না থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে অবশ্যই শহিদ মিনার থাকা প্রয়োজন। স্লিপ ও সংস্কারের টাকায় শহিদ নির্মাণের কাজ করা যায় না। শহিদ মিনার নির্মাণে অনেক টাকার প্রয়োজন। অনেক বিদ্যালয়ে নির্মাণের জায়গাও নেই। নতুন ভবন নির্মাণের ইষ্টিমিটে শহিদ মিনার নির্মাণ যুক্ত করে দিলে ভাল হতো। বর্তমানে সরাইলে ৩১ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের কাজ চলমান আছে। এই গুলোতেও শহিদ মিনারের কাজ ধরা নেই। সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেজবা উল আলম ভূঁইয়া বলেন, প্রতিটি বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার নির্মাণের ইচ্ছা আমাদের আছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে প্রত্যেক বিদ্যালয়ে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহিদ নির্মাণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।