ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে তিতাস নদীর অবৈধ দখল ছাড়বেন না আ’লীগ নেতা আবু তালেব। দখলদারদের উচ্ছেদ ঠেকাতে সক্রিয় হয়ে ওঠছেন বিভিন্ন সেক্টরের দালাল চক্র। ভিডিও বার্তায় চলছে কৌশলী কারিশমাটিক আলোচনা। স্থানীয়রা বলছেন, জাল দলিল তৈরী করে শুধু নদী/সরকারী জায়গা নয়, ব্যক্তিগত ভাবে অনেক ব্যক্তিকে পথে বসিয়েছেন অরূয়াইলের ভূমিখেকো সিন্ডিকেট।
ইউপি চেয়ারম্যান বলছেন, নদীসহ সরকারের ২শত কোটির টাকার সম্পদ দখলদারদের কবল থেকে উদ্ধার জরূরী। আর আ’লীগ নেতার ‘লাভ হবে না’ উক্তিটি সরকার বিরূধী। ইতোমধ্যে ইউএনওকে মামলা করার হুমকিও দিয়েছেন আ’লীগ নেতাসহ কয়েকজন দখলদার। ইউএনও বলছেন জাতীয় নদী কমিশনের তথা সরকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিধি মোতাবেক যা করার সবই করব।
সরজমিন অনুসন্ধানে ইউএনও’র দফতর, স্থানীয় বাসিন্দা ও দখলদার সূত্র জানায়, উপজেলার অরূয়াইলে কয়েক যুগ ধরে সক্রিয় কয়েকটি ভূমিখেকো সিন্ডিকেট। প্রত্যেকটি সিন্ডিকেটে রয়েছে ২-৩ জন করে নেতা। রাজনৈতিক বা স্থানীয় আধিপত্য নিয়ে বিরোধ থাকলেও জায়গা দখল ও সর্দারি বাণিজ্যের সময় তারা ঐক্যবদ্ধ। ওই সিন্ডিকেটের নেতারা হিন্দু লোকের নামে জাল দলিল তৈরী করে বিতর্কিত জায়গার একাধিক বিক্রয় দেখিয়ে ক্রয় সূত্রে মালিকানা দেখান। মনগড়া বিএস, আরএস খতিয়ান তৈরী করা তাদের জন্য মামুলি বিষয়। এ ভাবেই ওই এলাকার অনেক ব্যক্তি রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাচ্ছেন। হাওর অঞ্চল হওয়ায় ওই ইউনিয়নের মানুষ বাড়ছে। বাড়ছে না জায়গা। তাই দিন দিন সেখানে জায়গার দাম বেড়েই চলেছে। সুযোগ নিচ্ছেন ভূমিখেকোরা। যেনতেন ভাবে চলছে তাদের দখল কার্যক্রম। ১ নং খাস খতিয়ান ও নদীর জায়গার লোভ বেশী তাদের। তাই কৌশল করে দখল করছেন। দখলকে পাকাপোক্ত করতে কাগজও তৈরী করে চলেছেন।
এ ভাবে অরূয়াইল বাদে, অরূয়াইল এলাকায় তিতাস নদীকে ইচ্ছেমত দখল করেছেন ভূমিখেকোরা। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় পত্রিকায় দখলের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর তাদের নদী দখলে হাত দেয় জাতীয় নদী কমিশন। সরজমিন ঘুরে তারা সেখানকার তিতাস নদীর দখলদারদের চিহ্নিত করেছেন। নদীর ও খাস খতিয়ানের দখলকৃত জায়গার দখল ছাড়তেই গত ৯ ই মে তাদেরকে পত্র দিয়েছেন সরাইল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাসরিন সুলতানা। পত্র প্রাপ্তির ৩ দিন চলে গেলেও এ বিষয়ে তাদের কোন অনুভূতিই নেই। দখলের জায়গার মার্কেট বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বহাল তবিয়তে আছেন। এখন পর্যন্ত একটি মালামালাও সরাননি কেউ। তাদের সাফ কথা ক্রয় বা লীজ সূত্রে মালিকানার কাগজপত্র আছে। আমি কেন দখল ছাড়ব? দখলদার ইউপি আওয়ামী লীগ নেতা আবু তালেব নদী দখলের কথা স্বীকার করে বলেন, নিজের জায়গা বরাবর মাটি ফেলতে গিয়ে নদীর ৪-৬ ফুট পর্যন্ত অনেকেরই দখলে এসেছে। এই জায়গায় কোন রাস্তা হবে না। সরকারের কোন কাজেও আসবে না।
লাভও হবে না। আগেও কয়েকবার মাফ শেষে লাল দাগ দিয়েছেন প্রশাসন। কিন’ চুড়ান্ত পর্যায়ে মামলা ও কাগজের কারণে কিছুই করতে পারেননি। তাই শেষ পর্যন্ত নদীর দখল না ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এক ভিডিও বার্তায়ও তিনি দখলের পক্ষে কথা বলে উচ্ছেদ না করতে নানান যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তিনি আরো বলেন, বাজারের দক্ষিণ পাশে (বিএডিসি সংলগ্ন) নদীর বিশাল জায়গা দখল করে ফেলেছেন একটি চক্র। সেটি উদ্ধার করা জরূরী। দখলদার সোহেল ভূঁইয়া, দক্ষিণ বাজারের নুর উদ্দিন ও ইসমাইল মিয়া বলেন, পত্র পেয়েছি। দখল ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। অনেক মাপ দেখেছি। লাল দাগও দেখেছি। আমাদের বৈধ কাগজপত্র আছে। অনেক জায়গার উপর মামলা মোকদ্দমাও আছে। রায় আছে। আগে কিছুই করতে পারেনি। এবারও পারবেন না। মো. ইসমাইল মিয়া দখল ও উচ্ছেদের পত্র প্রাপ্তির কথা স্বীকার করে বলেন, সঠিক কাগজপত্রে দখলে আছি।
উচ্ছেদ করতে আসলে দেখাব। এখন দখল ছাড়ব কেন? অরূয়াইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, নদী ও খাস খতিয়ান মিলে সেখানে সরকারের প্রায় ২শত কোটি টাকার সম্পত্তি সম্পূর্ণ অবৈধ পন্থায় দখল করে রেখেছে একটি সিন্ডিকেট। এই দখলের সাথে স্থানীয় ভূমি অফিসের কিছু লোক জড়িত। বেশ কয়েকবার সাবেক ইউএনও ও এসি ল্যান্ডরা সরকারী সার্ভেয়ারের মাধ্যমে মাপযোগ করেছেন। দখলদার চিহ্নিত করে লাল কালির দাগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভূমি অফিসের কতিপয় অসৎ কর্মকর্তার কারণে কিছুই হয়নি। এবারও দখলদারদের রক্ষা করতে বিভিন্ন পর্যায়ের দালাল চক্র কাজ শুরূ করেছে। এরা সামান্য টাকা পেলেই মানুষকে কৌশলে ভুল বুঝাতে শুরূ করে। এদের কোন চরিত্র নেই। আমি স্থানীয় সরকারের ইউনিয়নের প্রধান হিসেবে নদীসহ সকল দখলকৃত জায়গা উদ্ধার চাই। সেই সাথে অবৈধ দখলদারদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
‘তরী’ বাংলাদেশ-এর আহবায়ক শামীম আহমেদ বলেন, দখলদারদের খুঁটির জোর কোথায়? অবৈধ পন্থায় নদী দখল দূষণ করে প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষা বিনষ্ট করার অধিকার কারো নেই। আমরা প্রয়োজনে দখলদারদের বিরূদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলব। সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মো. মেজবা উল আলম বলেন, জাতীয় নদী কমিশনের সিদ্ধান্ত ও তালিকা অনুযায়ী নদীর দখলদারদের দখল ছাড়তে সময় বেঁধে পত্র দিয়েছি। দখলদার কয়েকজন গত রোববার আমার দফতরে এসেছিলেন। উচ্ছেদ কার্যক্রম ঠেকাতে তারা আমার নামে মামলা করার হুমকি দিয়েছেন। সরকারী সিদ্ধান্ত বা আদেশ প্রত্যেক নাগরিকই মানতে বাধ্য। তবে বিধি অনুসারে সরকারী নির্দেশ অমান্যকারী ব্যক্তি যে-ই হউন তার বিরূদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করা হবে।