ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে কোন ধরণের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই অবাধে চলছে নদী দখল। ফলে দখল দূষণে বিষিয়ে ওঠেছে অরূয়াইলের তিতাস নদীর পানি ও পরিবেশ। গত দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট কৌশলে দখল করে আসছে তিতাস। নদীর জায়গায় গড়ে তুলছে স্থায়ী ইমারত। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ওরা দখল বিক্রিও করছে। দখলকে কেন্দ্র করে সেখানে অনেকবার দাঙ্গা হাঙ্গামাও হয়েছে। দখল ধরে রাখতে ওই ভূমি খেকো সিন্ডিকেটের সদস্যরা ইউএনও এসি ল্যান্ডের বিরূদ্ধে মামলাও করেছেন। এই বিষয়ে বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় একাধিকবার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। নজর পড়ে স্থানীয় প্রশাসন ও নদী কমিশনের। নির্দেশ আসে নদীর সীমানা চিহ্নিত করার। উপজেলা প্রশাসন একাধিকবার পরিমাপ করে দখলদার চিহ্নিত করলেও উচ্ছেদ করতে পারেননি। অবশেষে আবারও ইউপি আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ ৩০ জন নদী দখলদারকে চিহ্নিত করেছেন নদী কমিশন ও প্রশাসন। গত ৯ মে সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাসরিন সুলতানা স্বাক্ষরিত এক পত্রে দখলদারদের দখল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে ১৫ দিনের মধ্যে দখল না ছাড়লে বিধি মোতোবেক বাজেয়াপ্ত ও উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করবেন।
সরজমিন, সহকারী কমিশনারের কার্যালয় ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, সরাইল উপজেলার অরূয়াইল/ বাদে অরূয়াইলে অবৈধ পন্থায় তিতাস নদী দখলের প্রতিযোগিতা চলছে দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে। দখল দুষণে নদীর পানির রং নষ্ট হচ্ছে। পরিবেশ হারাচ্ছে স্বাভাবিক ভারসাম্য। ফলে দিনদিন ছোট হয়ে আসছে নদী। হারাচ্ছে নাব্যতা। বিলীন হতে চলেছে মাছ ধরার জাল। দূর্লভ হয়ে যাচ্ছে নদীর মাছ। দীর্ঘ যুগরও অধিক সময় ধরে সরাইল উপজেলার অরুয়াইলে তিতাস নদীতে চলছে এ দখল তান্ডব। নদী দখলে ভূমি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের যোগসাজশের অভিযোগ করছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান। কৌশলে নদী দখল করে প্রথমে মাটি ফেলে ভরাট করেন। অবস’া বুঝে নির্মাণ করেন আরসিসি প্রতিরক্ষা দেওয়াল। কেউ কেউ ৬০/৭০/৮০ ইঞ্চি প্রসে’র ইটের গাতনিও দেন। কিছু দিন পর গড়ে তুলেন স’ায়ী ইমারত। লাখ লাখ টাকা জামানত নিয়ে মোটা অংকের টাকায় ভাড়া দেন। অনেকে নিজের দখল বিক্রিও করে দেন। অরুয়াইল ও পাকশিমুল গ্রামের সীমানা ঘেষে প্রবাহিত হয়েছে তিতাস নদী।
হাজার বছরের ঐতিহ্য বুকে ধারন করে আছে তিতাস। দেশের বিভিন্ন জেলার সাথে নৌ পথে ওই ইউনিয়নের বাসিন্ধাদের অবাধ যাতায়তের মাধ্যম হচ্ছে এ নদী। এ ছাড়া রয়েছে নদীর তরতাজা মাছ। বাদে অরুয়াইল মৌজার সাবেক ৩০৩ ও হালে ১৬৮ নং দাগের ওই নদীটি ১ নং খাস খতিয়ানভূক্ত। সেখানে নদীর দু’পাড়ে অনেক আগেই গড়ে উঠেছে দু’টি বাজার। নদীর পশ্চিম পাড়ে অরুয়াইল। আর পূর্ব পাড়ে পাকশিমুল গ্রাম। উভয় পাড়ে রয়েছে কলেজ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা। তিতাস নদীতে ভাসমান ছোট ডিঙ্গি নৌকাই ছিল দুই পাড়ের মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তখনও দখলদাররা ছিল সক্রিয়। ২০০৯ সালে নদীর উপর নির্মিত হয়েছে ২২৫ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৭মিটার প্রস্থ একটি সেঁতু। সেঁতুটি চালু হওয়ার পর আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে সেখানকার ভূমি খেঁকোরা। উভয় পাড়ে সেঁতুর দু’পাশ ঘিরে নদী দখলের প্রতিযোগীতায় নামে দখলদাররা।
নদীর পাড় ঘেষা বিএডিসি থেকে শ্বশান ঘাট পর্যন্ত ভিট মালিকরা নিয়মিত দখল করে চলেছেন নদী। দক্ষিণ বাজার এলাকায় চলছে নদীর জায়গা দখলের প্রতিযোগিতা। নুরূদ্দিন নামের এক ব্যক্তিই দখল করেছেন কোটি টাকা মূল্যের জায়গা। এভাবে দখল চলছে ধামাউড়া নৌঘাট এলাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া ড্রেজারযুক্ত ইঞ্জিন চালিত নৌকা দিয়ে বালু এনে তারা নদীর পাশে ফেলে। পরে খুঁটি বসিয়ে আস্তে আস্তে মাটি ভরাট করে। প্রথমে টিনের ঘর। কিছুদিন পরই চলে পাকা ইমারত নির্মাণের কাজ। পরে চড়া মূল্যের জামানত ও ভাড়ায় দিয়ে দেয় দোকান। কোটি টাকা বাজেটের নৌকা তৈরী করতে নদী দখল করে চালায় ওয়ার্কসপের (ডগ ইয়ার্ড) কাজ। একটি নৌকা তৈরী করতে সময় লাগে ৩-৪ মাস। নদীর ২০-৩০ জায়গায় চলছে ডগের কাজ। পশ্চিম পাড় অরুয়াইলে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরী করা হয়েছিল একটি পাকা ঘাটলা। যেখানে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পণ্যবোঝাই নৌকার মালামাল উঠানামার কথা ছিল। কিন’ দখলদাররা এত বড় ঘাটলা খালি পড়ে থাকার লোভ সামলাতে পারেনি। তারা কৌশলে সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসের সহায়তায় ওই ঘাটলাকে ফেরিফেরি করে বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলে গত ৪-৫ বছর আগে।
ওই ঘাটলার পূর্ব পাশে নদীতে আরো মাটি ফেলে দখলে নেয় ভূমি খেঁকুরা। সুবিধা বঞ্চিত হয় নদী তীরবর্তী ব্যবসায়িরা। আর মাটি চাপা পড়ে যায় সরকারের অর্ধ-কোটি টাকা। সম্প্রতি সেই ঘাটলা উদ্ধার করেছেন উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসন। তবে উদ্ধারের কাজ এখনো শতভাগ সম্পন্ন হয়নি। লালকালি দিয়ে চিহ্নিত করে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেন তৎকালীন ইউএনও ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মোহাম্মদ এমরান হোসেন। দখল ধরে রাখতে ইউএনও এসি ল্যান্ডের বিরূদ্ধে মামলা করে দেন দখলদাররা। পরবর্তীতে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন ইউএনও এসিল্যান্ড ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সার্ভেয়ার মিলে মাপযোগ করেন। তারা অবৈধ দখলদারের তালিকাসহ নদী রক্ষা কমিশনে প্রতিবেদন প্রেরণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সেখানকার ৩০ দখলদারের প্রত্যেককে গত ৯ মে স্বাক্ষরিত পত্র প্রেরণ করেছেন এসি ল্যান্ড। পত্রে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে অবৈধ দখলদারদের দখল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাকা, আধাপাকা, টিনের ঘর ও মাটি ভরাট সকল প্রকার দখল সরিয়ে নিতে হরে।
অন্যতায় বিধি মোতাবেক বাজেয়াপ্ত ও উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে। তালিকাভুক্ত অবৈধ দখলদাররা হলেন- ইউপি আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু তালেব, মো. ইসমাইল মিয়া, ঠান্ডু মিয়া, রমিজ মাস্টার, মো. আব্দুর রউফ, আবুল কালাম, মো. সোহেল ভূঁইয়া, ইঞ্জি: আল হেলাল, কুদরত আলী, ডা: রফিকুল ইসলাম, নজরূল ইসলাম, ফারূক মিয়া, ছাদেক মিয়া, মুসলিম মিয়া, নুর উদ্দিন, মহাদেব দাস, মনমোহন দাস, রইছ মিয়া, সাইফুল ইসলাম, মো. উল্লাহ, জসিম উদ্দিন, হেলাল উদ্দিন, নুরে আলম, আলা উদ্দিন মাস্টার, আ: মন্নান, সজল রায়, নোয়াব মিয়া, মিরাজ আলী ও কাশেম মিয়া। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অরূয়াইলের একাধিক ব্যক্তি বলেন, এই ভূমিদস্যু দখলদারদের কাছে অরূয়াইল পাকশিমুলের সাধারণ মানুষ জিম্মি।
জায়গার দালালি, জোর পুর্বক দখল, জেনে শুনে বিতর্কিত জায়গা ক্রয়-বিক্রয় করে মানুষকে শোষণ করে কামাই করাই তাদের পেশা। ‘তরী’ বাংলাদেশের আহবায়ক শামীম আহমেদ বলেন, নদীর দখল দূষণ রক্ষায় উপজেলা প্রশাসন ও জাতীয় নদী কমিশনের নেয়া পদক্ষেপকে আমরা সাধুবাদ জানায়। এই কাজে তরীর কোন ধরণের সহযোগিতা চাইলে আমরা প্রস’ত। কারণ আমরা সবসময় আছি পরিবেশ ও সামাজিক সুরক্ষা আন্দোলনের পক্ষে। সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেজবা উল আলম ভূঁইয়া ৩০ নদী দখলদারকে চিহ্নিত করার কথা স্বীকার করে বলেন, ১৫ দিনের মধ্যে দখল ছাড়তে বলা হয়েছে। অন্যথায় আইন অনুয়ায়ি বাজেয়াপ্ত ও উচ্ছেদ পক্রিয়া পরিচালনা করব।