কেটে যাবে রাতের অন্ধকার। দূর হবে নিরবতা। থাকবে না ঝড় বৃষ্টির ভীতি। হারিয়ে যাবে খাওয়া দাওয়া ও ওয়াশ রূমের টেনশন। নির্বিঘ্নে কাটানো যাবে রাত। নিশ্চিত হতে চলেছে দিনের আলোয় নিরাপত্তা। দূরীভূত হবে বিনোদনের নামে প্রকাশ্যে বেহায়াপনা ও নোংরামি। হরেক রকম আলোর জ্বলকানিতে হাঁসবে আকাশী হাওর। হাঁসবে মিনি কক্সবাজার। দিনে রাতে বৃদ্ধি পাবে পর্যটকদের পদচারণা । উপজেলা জেলা পেরিয়ে গোটা দেশ ও পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে মিনি কক্সবাজারের খ্যাতি। এমন সব আশা ও স্বপ্ন পূরণ করতেই সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে সরাইলের মিনি কক্সবাজার এলাকায় নির্মাণ হচ্ছে আধুনিক মানের রিসোর্ট ও রেস্টুরেন্ট। স্বস্থির নি:শ্বাস ফেলছেন দর্শণার্থী ও পর্যটকরা। উদ্যোক্তা, দর্শণার্থী ও স্থানীয়রা জানায়, ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ। হাওরের মাঝখানে নির্মিত হয় সড়ক। নাম সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই আঞ্চলিক মহাসড়ক। নির্মাণের পরই সরাইলের কালিকচ্ছ ইউনিয়নের আকাশী হাওর বেষ্টিত কোলাহলমুক্ত ধর্মতীর্থ স্থানটি পর্যটকদের কাছে টানতে শুরূ করে। শুষ্ক বর্ষা দুই মৌসমেই সড়কের ২-৩ কিলোমিটার এলাকা মুখরিত থাকে পর্যটকদের পদচারণায়। বেশী জমজমাট থাকে বর্ষায়। হাওরের স্বচ্ছ পানির কলকাকলি আর আকাশের ছড়ানো রংয়ের মাধুরীতে মিশে যান সকল বয়সের নারী পুরূষ। সন্ধ্যায় এখানকার সূর্যাস্থের দৃশ্য সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের চেয়ে কোন আকর্ষণীয় নয়। সড়কের দুপাশে ব্লকের উপর বসে পানি মিশ্রিত প্রকৃতির শীতল হাওয়া ভোগ করেন পর্যটকরা। এক সময় নৌকায় বা স্পীডবোডে করে হাওরে ভ্রমণের সুযোগ হয়। সময়ের আবর্তে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাহির থেকে এখানে আসতে থাকেন দর্শণার্থীরা। শুষ্ক মৌসমেও এখানকার নয়নাভিরাম দৃশ্যের আকর্ষণে ছুটে আসেন পর্যটকরা। শুক্রবার ও ঈদের দিনে মানুষের স্রোত নামে। নাগরদোলায় ও ঘোড়ার পিঠে চড়ে আনন্দ উপভোগ করে শিশুরা। শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চলে পুলিশ প্রহরা। মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্বজোড়ে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে স্থানটির। কিন্তু ঝড় বৃষ্টিতে চরম অসহায় হয়ে পড়েন বিনোদন প্রেমীরা। সীমাহীন কষ্ট ও দূর্ভোগের শিকার হয় শিক্ষার্থী ও শিশুরা। কারণ এমন আকর্ষণীয় জায়গাটিতে রোদ ঝড় বৃষ্টিতে দাঁড়ানোর মত জায়গা নেই। একটি চায়ের দোকান নেই। বসার স্থান নেই। খাবারের রেষ্টুরেন্ট নেই। নেই কোন আবাসিক হোটেল। ওয়াশ রূম বা টয়লেট নেই। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। সন্ধ্যার পর সড়কটি ছিল ডাকাত দলের অভয়ারণ্য। হাজারো সমস্যা ও দূর্ভোগ থামাতে পারেনি পর্যটকদের। স্থানটিকে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণার দাবী ওঠতে থাকে। হোটেল মোটেল রিসোর্ট রেষ্টুরেন্ট করার আহবান আসতে থাকে। বিষয়টি নিয়ে মহান জাতীয় সংসদে কথা বলেন তৎকালীন এমপি এডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা। আশা ভরসায় চলে গেছে ১৭ বছর। কিছুই হয়নি। তবে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তৎকালীন পুলিশ প্রশাসনের সাহসী ও কঠোর পদক্ষেপে সড়কটির ডাকাত আতঙ্ক কেটে গেছে। বর্তমানে হাফেজ আলী নেওয়াজ, ইব্রাহিম মৃধা ও জিহাদ আহমেদ নামের তিন বন্ধু মিলে সেখানে প্রথমবারের মত গড়ে তুলছেন আধুনিক মানের একটি রিসোর্ট ও রেষ্টুরেন্ট। গত তিন মাস ধরে চলছে নির্মাণ কাজ। সরজমিনে দেখা যায়, সড়ক থেকে হাওরের পানির উপরে রেলিংযুক্ত একটি রাস্তা। এরপরই রিসোর্ট এন্ড রেষ্টুরেন্ট। গোটা রিসোর্টই বিভিন্ন ডিজাইন ও রং-এ সাজানো। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি। ইউরোপিয়ার ষ্টাইল। হাওরের বাতাস। পাল্টে যায় অনুভূতি। বাহারি সাজে সেজেছে ৮টি কটেজ। প্রতি কটেজে রয়েছে ৪টি টেবিল। প্রত্যেক কটেজে বসবেন ১৬ জন। এক সাথে কটেজে বসতে পারবেন ১২৮ জন। আপাতত খাবারের তালিকায় রয়েছে দেশীয় নাস্তা, বাংলা-চাইনিজ খাবার, এরাবিয়ান হেফসা সহ ভিন্ন স্বাদ ও মানের খাবার। কটেজের ভেতরে টয়লেট। নামাজের জন্য রয়েছে আলাদা জায়গা। রাতের রিসোর্ট পাল্টে দেয় গোটা সড়কের চিত্র। সোলার বাতির পাশাপাশি রিসোর্টের আলোতে উজ্জ্বল হয় হাওর ও সড়ক। পানির জ্বলমলানী দৃষ্টি কেড়ে নেয়। নির্মাণাধীন এই রিসোর্ট দেখে স্বসি’র নি:শ্বাস ফেলছেন দর্শণার্থী ও পর্যটকরা। রিসোর্ট চালু হলে কেটে যাবে পর্যটকদের হাজারো সমস্যা। এমনটা ভেবে তারা এখনই আনন্দে ভাসছেন। রিসোর্টে ঘুরছেন। ফটো সেশন করছেন। ফেসবুকে ছবি আপলোডের আনন্দের বার্তা ছড়াচ্ছেন। দর্শণার্থী শিক্ষার্থী কাশফিয়া, রজত, আলমগীর, রেখা ও নাঈম জানায়, রিসোর্টটি হাজারো সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখবে। কেউ আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে না। দিনের বেলায় ছিনতাই হবে না। নির্জনতার সুযোগে বিনোদনের নামে নোংরামি হ্রাস পাবে। রিসোর্ট নির্মাণের উদ্যোক্তা জিহাদ আহমেদ, আলী নেওয়াজ ও ইব্রাহিম মৃধা বলেন, বিনোদন প্রেমি মানুষদের সমস্যার কথা ভেবেই আমরা ১৫ বিঘা জায়গার উপর যৌথ প্রচেষ্টায় রিসোর্ট নির্মাণ করছি। এটি শুধু ‘মিনি কক্সবাজার’ নামের পর্যটন কেন্দ্রের সমস্যা সমাধান নয়। এটি সরাইলের নামকে উজ্জ্বল করবে। পরবর্তীতে অন্যান্য উদ্যোক্তারাও এখানে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবেন। আমাদের কটেজ গুলোতে সকল প্রকার খাবার ও নামাজের সুবিধা রয়েছে। পাশে আরো ১২৫ বিঘা জমি রয়েছে। সেখানে বহুতল ভবন, অত্যাধুনিক শিশু পার্ক, বিনোদনের জন্য স্থাপনা সহ অন্যান্য সুবিধার কাজ করব। ঘুরতে এসে সরাইল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মৃধা আহমাদুল কামাল, সরাইল প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. আইয়ুব খান, ত্রিতাল সংগীত নিকেতনের অধ্যক্ষ লেখক গবেষক সঞ্জীব কুমার দেবনাথ ও মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ বদর উদ্দিন বলেন, ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে সরাইল প্রেসক্লাবের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মাহবুব খান দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় ‘সরাইলের মিনি কক্সবাজার’ শিরোনামে স্থানটির গুরূত্ব প্রয়োজনীয়তাসহ বহুল তথ্যযুক্ত একটি ফিচার লিখেছিলেন। সেই থেকে ‘মিনি কক্সবাজার’ নামটি ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। জায়গাটিকে ঘিরে পর্যটকরা বারবার সম্ভাবনাময় একটি শিল্পের ইঙ্গিত করছেন। পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা ও দর্শণার্থীদের সুযোগ সুবিধার দাবীও অনেক দিনের। দীর্ঘদিন পরে হলেও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত রিসোর্ট আশার আলো দেখাচ্ছে। এখন আমরা স্থানটিকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্রের স্বীকৃতি পাওয়ার স্বপ্ন দেখতেই পারি। সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আরিফুল হক মৃদুল বলেন, এ জনপদের মানুষদের বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় বরিং ফিল করে আসছিল। এছাড়া আশপাশের গ্র্যান্ড সুলতানের মত রিসোর্ট গুলো খুবই ব্যয়বহুল। সেখানে যাওয়া অনেকটা সাধ্যের বাহিরে। তাই এখানে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা রিসোর্টটি তাদের বিনোদনে গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটি এখানকার লোকদের জীবন মানে পরিবর্তন ঘটাবে। একটি দেখে অন্যরাও এগিয়ে আসবে। আমি রিসোর্টটির উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করছি।
মাহবুব খান বাবুল