মাহবুব খান বাবুলঃ সরাইল থেকেঃ
শহিদ বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আকবর হোসেন বকুল মিয়ার সমাধিতে যথারীতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সরাইল প্রেসক্লাব। আজ ১৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় সরাইল সদরের আলীনগরে বকুল মিয়ার সমাধির পাশে হাজির হন প্রেসক্লাবের সদস্যরা। উনার সমাধিতে পুস্পস্তবক অর্পণ শেষে কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া করেন। স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও শহিদ বুদ্ধিজীবী আকবর হোসেনের স্বরণে সরকারী ভাবে কোন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে না। জানানো হচ্ছে না কোন ধরণের সম্মান বা শ্রদ্ধা। পাচ্ছেন না সরকারী কোন সুযোগ সুবিধা্র। উনার সমাধিটি কোথায়? তাও জানা নেই অনেকের। তবে দেশের জন্য আত্মোৎসর্গকারী এই বীর পুরূষের কবর পরিচ্ছন্ন করে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধা জানানোর কাজটি করে আসছেন ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী সরাইল প্রেসক্লাব। দেশ প্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ঐতিহ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন তারা। সেই সাথে নতুন আরেকটি ইতিহাস গড়েছে সরাইলের সাংবাদিকদের এ সংগঠনটি। আজ বুধবার ১৪ ডিসেম্বর ছিল ৫১তম শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দিবসটি পালন উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৯টায় সরাইল প্রেসক্লাবের সদস্যরা চলে যান সরাইল সদরের আলীনগর সৈয়দ বাড়ির কবরস্থানে। সৈয়দ আকবর হোসেন বকুল মিয়ার সমাধিতে পুস্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। পরে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কোরআন তেলাওয়াত শেষে উনিসহ সকল শহিদদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে করেছেন তারা। শহিদের স্ত্রী নুরূল আক্তার (৭৩) কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, পাঞ্জাবীরা বাড়ি থেকে নিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করল আমার স্বামী আকবর হোসেন ও দেবর আফজাল হোসেনকে। ৫১টি বছর গেল। ফুল তো দুরের কথা। মানুষটির কবরে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে কেউ আসেননি। কবরটি সংস্কার বা সৌন্দর্য বর্ধনেও কারো কোন উদ্যোগ নেই। আমরা কিছুই চাইনি। চেয়েছিলাম শুধু সম্মান। তাও তো ভাগ্যে জুটেনি। ৫০ বছর পর গত ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর সরাইল প্রেসক্লাবের লোকজন কবরটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করেছেন। ফুল দিয়ে সম্মান জানিয়েছেন। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া করছেন। খুশি ও আনন্দে বুকটা ভরে গেছে। সরাইল প্রেসক্লাবও বকুল মিয়ার মত আরেকটি ইতিহাসের জন্ম দিল। কারণ শহিদ বুদ্ধিজীবী বকুল মিয়ার সমাধিতে প্রেসক্লাবই প্রথম শ্রদ্ধা জানালো। এর আগে কেউ এ কাজটি করেননি। প্রেসক্লাবের কাছে বকুল মিয়ার পরিবার ঋণী হয়ে গেল। তিনি আরো বলেন, স্বামী হারানোর পর তিন শিশু সন্তান নিয়ে অনেক কষ্ট করেছি। কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। এখন পর্যন্ত সরকারি কোন ভাতা পায়নি। শেখ সাহেব একবার আমাকে ডেকে নিয়ে ২ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে ঢাকা বার সমিতির মূল ফটকের সামনে ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’ নামের স্মৃতিফলকে ৬ জন শহীদ আইনজীবির নামের সাথে বকুল মিয়ার নাম রয়েছে। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া কাউতলীর গোল চক্করে ‘সৌধ হিরন্ময়’ সৌধে উনার নাম আছে। ১৯৯৮ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবি সৈয়দ আকবর হোসেনের নামে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ কর্তৃক “শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মারক ডাক টিকেট” উম্মোচন করেছেন। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে শহীদ ১৯১ জন বুদ্ধিজীবীর গেজেট হয়েছে। সেখানে আকবর হোসেনর নাম স্থান পেয়েছে। কিন্তু উনার কবরটি রক্ষণাবেক্ষণ বা সৌন্দর্য বর্ধণে সরকারি কোন উদ্যোগ আজো জুটেনি। একজন শহিদ বুদ্ধিজীবীর সমাধি এভাবে অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকতে পারে না। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, শহিদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবার বা কবরের উন্নয়নের জন্য কি সরকার কিছুই করছেন না? সরাইলের প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিরা তো গত ৫১ বছরের মধ্যে বকুল মিয়ার কবরের জন্য কিছু করতে দেখিনি। ফুলও দেয়নি। সরাইল প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. আইয়ুব খান, মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ গণমাধ্যম কর্মী মোহাম্মদ বদর উদ্দিন ও সরাইল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মাহবুব খান বলেন, আমরা ভাষা শহিদদের প্রতীকী সম্মান জানাই। আর ৪ যুগেরও অধিক সময় পরও একজন শহিদ বুদ্ধিজীবীর সমাধিতে বছরে একবার কেউ শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে অনেক পূর্ব থেকেই ভাবছিল সরাইল প্রেসক্লাব। প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর সরাইল প্রেসক্লাব এই শহিদ বুদ্ধিজীবীর সমাধিতে ফুল দিয়ে সম্মান জানাবে। করবে কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া। এ কাজটির মাধ্যমে সমাজের দর্পণ ও রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ খ্যাত সাংবাদিকদের সংগঠন সরাইল প্রেসক্লাব কিছুটা হলেও ঋণমুক্ত হয়েছে। সরকারের কাছে আমাদের দাবী সরাইলের এ কৃতি সন্তান দেশ মাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গকারী বকুল মিয়ার সমাধিকে সংস্কার করে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হউক। বুদ্ধিজীবী দিবসের তাৎপর্য ও শহিদদের ইতিবৃত্ত সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করা হউক। উপজেলা চত্বরে নির্মাণ করা হউক স্মৃতি স্তম্ভ। তবেই আগামী প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ ও শহিদ বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে জানতে পারবে। তাদের মধ্যে জাগ্রত হবে দেশ প্রেম।
প্রসঙ্গত: ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর সকাল বেলা। কোরআন তেলাওয়াত করছেন বকুল মিয়া। হাজির পাকবাহিনী। স্ত্রী স্বজনদের সামনে চোখ বেঁধে নিয়ে যান তাকে। পরের দিন ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেনকে আটক করেন। দুজনই নিখোঁজ। ৪ দিন পর কুরূলিয়ার খাল পাড়ে মিলে দুই ভাইয়ের লাশ। বড়ই নির্মম! তাদের বুক পেট বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝড়া। অনেক অনুরোধের পর মন গলে বর্বরদের। ১০ ডিসেম্বর তাদের লাশ এনে দাফন করা হয়। আজ পর্যন্ত ওই বুদ্ধিজীবীর কবরে কারো শ্রদ্ধা নেই। নেই কোন সংস্কার।