বাবার সেই চিঠি শুধুই মনে
—–আল আমীন শাহীন
চিঠি, বাবার সেই চিঠি, বারবার মনে পড়ছে অন্তর রহমানের । অপারেশন থিয়েটারে মৃত্যুপথচারী একমাত্র পুত্র , এই বিপদের সময়ও বাবার চিঠিটার কথা ভুলতে পারছেন না তিনি। তার পুত্র যদি চিঠির সেই যুগ পেতো , চিঠির যে গুরুত্ব তা অনুধাবন করতো, তাহলে তার আজ এ অবস্থা হতো না। অন্তর রহমান হাসপাতালের সার্জারী ওয়ার্ডের সামনে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন আর এমনই ভাবছেন।
কিছুদিন আগে তিনি দেশে ফিরেছেন, প্রবাসে থেকে কষ্টার্জিত আয়ে পরিবারকে সুখে রাখার চেস্টা করেন সবসময়। অতিরিক্ত সুখ যে তার বংশের প্রদীপ নিভিয়ে দেয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে তা তিনি ভাবেন নি। মোটর সাইকেল দূঘটনায় আহত হয়ে অন্তর রহমানের দশম শ্রেণী পড়ুয়া পুত্র সাকিফ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। স্ত্রী সেলিনা রহমান কিছুক্ষণ আগে হাসপাতালের করিডোরে চিৎকার মাতামাতি করেছে, বারবার বলেছে,“ কি হলো, কি হলো, আমার সাকিফ, আমার সাকিফ। শুনলো না, আমার কথা শুনলো না। এই ছিলো তার আর্তনাদ।
অন্তর রহমান নির্বাক, কোন কথা বলছেন না, শুধুই ভাবছেন , ৪ বছর প্রবাসে ছিলেন, সেই প্রবাসী জীবন , আপনজন সংসার ফেলে যাওয়ার চিনচিন কষ্টটা সঙ্গী থাকতো সব সময়। তার পুত্র সাকিফ রহমান অষ্টম শ্রেনীতে উঠার পরই কেমন যেন পরিবর্তন হতে লাগলো, আধুনিকতায় বেশী মিশে গিয়ে ছেলেটি সারাদিন ব্যস্ত থাকে মোবাইল ফোন নিয়ে,গেইম চেটিং এসবে। একা রুমে থাকতে পছন্দ করে, কথাবার্তা খিটখিটে হয়ে গেছে, সে যা বলে তার যুক্তি ছাড়া অন্য কোন যুক্তি যেন নেই এবং সে মানে না। তার যুক্তিও সবাইকে মানতে হবে। বিষয়টা সাকিফের মা তেমনটা বুঝেন নি, ছেলে যা চেয়েছে তার ইচ্ছাই পূরণ করেছে।
এক্সিডেন্ট হওয়ার ৬ মাস আগের কথা, সাকিফ বায়ণা ধরলো তাকে মোটর সাইকেল কিনে দিতে হবে, সেলিনা রহমান রাজি হননি। তাতে সাকিফ প্রথমে বাসায় রাগারাগি, চুপচাপ থাকা, এক সময় তর্ক করে আসবাবপত্র ভাঙচুর করা, বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি দেয়, এতো কিছু সইতে না পেরে অবশেষে মোটর সাইকেল কিনে দিতে বাধ্য হয় সেলিনা রহমান।
অন্তর রহমান দেশে ফিরেছেন অনেকদিন পর, ছেলের সাথে গত ৪ বছর ধরে কথা হয়েছে তবে তা খুবই সংক্ষিপ্ত, একদিন সাকিফ অন্তর রহমানকে বলে দিয়েছেন, তুমি ম্যাসেজ দিয়ে রেখো,আমি ম্যাসেজে উত্তর দিব। এভাবে যোযেযোগের ক্ষেত্রটা কেমন জানি মনের টান হারায়।
অন্তর রহমান ভাবছেন তার ছেলেবেলার কথা , মনে পড়ছে সেই বিদেশী খামে ভরা চিঠি , চারপাশে লাল নীল ছোট ছোট টুকরোর মতো ছাপ দেয়া , গোল্ড শিলমারা সেখানে ইংরেজীতে লিখা ঠিকানা প্রাপক এবং প্রেরকের। বিদেশী চিঠি। সেসময় একটি চিঠি আসবে তার জন্য কত অপেক্ষা থাকতো সবার। একই পাড়ায় বাস করতেন ডাক বিভাগের ডাক পিয়ন বশীর মিয়া, খাকি পোষাক পড়ে বাড়ির সামনে এসে সাইকেল এর ঘন্টি বাজাতেন তিনি, বাড়ির সবাই ছুটে যেত গেইটের সামনে নিশ্চয় চিঠি এসেছে। বশীর মিয়ারও কদর ছিল পাড়ায় পাড়ায়।
অন্তর রহমান তখন তার পুত্র সাকিফের বয়সী। সাদা কালো থেকে রঙ্গিন টিভি বাংলাদেশে চালু হয়েছে। রঙ্গিন টিভি কেনার শখ অন্তরের। একটি ঘড়ি লাগবে, একটি বাইসাইকেল ইত্যাদি আবদার করে সে তার বাবার কাছে চিঠি লিখেছিলো, আগের সেই চিঠি লিখতে হতো সুন্দর হাতের লেখায়, চিঠির শুরুতে ছিল শ্রদ্ধা নিবেদন, স্থান তারিখ, তারপর কুশলাদী জিজ্ঞাস, চিঠিতে চাওয়া আবদারটাও সুন্দর এবং নমনীয়ভাবে করা হতো, বাড়ির সবার খবর জানানো হতো , চিঠির শেষ দিকে আবারও শ্রদ্ধা নিবেদন ইত্যাদি। ইতি কথাটি লিখে লিখতে হতো আপনার আদরের পুত্র অন্তর। সেই চিঠি টা যেন অন্তর রহমান এর চোখের সামনে ভাসছে। কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল অথচ দিনে দিনে সেই চিঠি , সেই ডাক বাক্স , সেই ডাক পিয়ন , খাম , সব হারিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে।
অন্তর রহমানএর বাবা প্রবাসে থাকতেন, দূভাগ্য তিনি দেশে জীবন নিয়ে ফিরতে পারেন নি। দেশে ফেরার তারিখের ১০ দিন আগে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মুত্যবরণ করেন। লাশ হয়ে ফেরেন কফিনের বাক্সে। দেশে আসার পর বিভিন্ন মালামাল ও ব্যাগ আসে । একটি ব্যাগে আদরের ছেলের চিঠিগুলো তিনি যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছিলেন। কত মমতা আর যত্ন ছিল এই এক একটি চিঠির। অন্তর তার বাবার লিখা শেষ যে চিঠিটা পেয়েছিলেন , সেই চিঠিটা ছিলো অত্যন্ত গুররুত্বপূণ।র্ যা অন্তরকে জীবনযাত্রায় এখন সেই শিক্ষা ও প্রেরণা দেয় এখনও। চিঠিতে বাবা লিখেছিলেন, “অন্তর বাবা আমার , তোমার জন্মের দশ বৎসর পূর্বে তোমার নাম রেখেছি, অন্তর । তোমার আসল নাম আল আমিন রহমান অন্তর অর্থাৎ বিশ্বাসী মন। তোমার এই মনটির প্রতি আমার অনেক বিশ্বাস আছে তুমি শুদ্ধধারায় জীবনে চলবে। সকলের কাছে, কাজে কর্মে তুমি বিশ্বাসী হবে, সুন্দর মন নিয়ে বাঁচবে। আশা করি আমার বিশ্বাসকে তুমি মর্যাদা দেবে এবং অক্ষুন্ন রাখবে। – ভালো থেকো বাবা , মহান আল্লাহ তোমার সহায় হোক—ইতি তোমার বাবা ” এমন চিঠি লিখতে পারেননি অন্তর রহমান তার পুত্র সাকিফকে । সময়ের আধুনিকতার ব্যবধানে মনের মায়া বন্ধন নেই বলেই মনবন্ধন জুড়তে পারেনি নি তেমন ভাবে পুত্রের সাথে, এই বেদনা এখন তার।
হঠাৎ করে সার্জারী ওয়ার্ডের অপারেশন থিয়েটারের লাল বাতিটি নিভে গেল, একজন ডাক্তার জানালেন সাকিফের জ্ঞান ফিরেছে। অন্তর রহমান বল্লেন, “আলহামদুলিল্লাহ”। ছুটে গেলেন পুত্রের কাছে, মাথায় হাত বুলিয়ে বল্লেন,“ বাবারে তোর জ্ঞান ফিরেছে, কত অপেক্ষায় ছিলাম। সাকিফ দেখলো তারা বাবার চোখে পানি, সে আস্তে আস্তে বল্লো, “হ্যাঁ বাবা আমাকে মাফ করে দিও, আমি ভুল করেছি, আমার জ্ঞান ফিরেছে, আর এমন ভুল করবো না। অন্তর রহমান আবারো বল্লেন আলহামদুলিল্লাহ।
লেখক : সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব, সভাপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।
aminshaheen2009@gmail.com/ মোবাইল ফোন : ০১৭১১১০১৬৮২