ওরা প্রত্যেকেই দরিদ্র পবিরারের সন্তান। নিজের বাড়ি নেই। তাই সরকারের দেয়া ঘরেই বসবাস করতেন। শ্রম বিক্রি করেই চলতো তাদের সংসার। কেউ কেউ বুট বাদামও বিক্রি করতো। কোন রকমে অর্ধাহারে অনাহারে চলতো পরিবার গুলো। মোহাম্মদ আলীর ছেলে ইরফানও সেখানেই থাকতো। তারা সকলেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা কুন্ডা ইউনিয়নের তুল্লাপাড়া আদর্শ গুচ্ছ গ্রামের বাসিন্দা। কয়েক বছর আগে আরব আমিরাতে গিয়ে বদলে যায় গুচ্ছ গ্রামের ইরফান। টাকা কামাতে মানবপাচারের নতুন ফন্দি আটে। ফন্দি কাজে লাগাতে স্ত্রী পারূল বেগমকে নামিয়ে দেন মাঠে। টার্গেট বেকার যুবকদের পরিবার। অল্প সময়ে গুচ্ছ গ্রামের বেকার যুবকদের মায়ের ধর্ম মেয়ে হয়ে যান পারূল। প্রলোভন দেখান স্বামী ইরফানের মাধ্যমে প্রবাসে নিয়ে লাখ লাখ টাকা ইনকামের। অনেককে ফুসলিয়ে কোটি টাকা নিয়েছেন পারূল। পারূল ইরফানের ফাঁদে পড়ে ধার দেনা আর সুদে ১২ যুবক আরব আমিরাতে গিয়ে বড় ধরণের বিপদে পড়েছে। গত ১৩ দিন ধরে এক কক্ষে বন্দিদশায় আছে যুবকরা। বাহির থেকে তালা দেয়া ওই কক্ষে শুধু পানি পান করে বেঁচে আছে। কঠিন মানবেতর জীপন-যাপন করছেন তারা। কেউ কেউ আবার মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। সুখের স্বপ্নে টাকা খরচ করে সন্তানকে প্রবাসে পাঠিয়ে এখন ইরফানের বসতঘরের সামনে বসে বসে আহাজারি করছেন অভিভাবকরা।
সরজমিনে ওই গুচ্ছ গ্রামে গেলে এগিয়ে আসেন বিভিন্ন বয়সের নারী পুরূষ। তাদের প্রত্যেকের চোখে পানি। মুখে বিষাদের চাপ। প্রবাসে পাঠিয়ে সুখের বদলে সন্তানদের কষ্ট কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। ইরফান ও পারূলকে তারা প্রতারক, দালাল ও মানবপাচারকারী বলে উল্লেখ করছেন। প্রবাসী রমজানের মা বেগম বিবি বলেন, ইরফান আর পারূল কইছে, মাস শেষে আমার পুতেরে লাখ টেহা বেতন দিব। একটা সমিতি থাইক্কা ১ লাখ গেরামের এক লোক থাইক্কা চড়া সুদে আরো ১ লাখ লইয়া লইছি। বাড়ির একটা ক্ষেত বেইচ্ছা লাইছি। সবশেষ কইরা পুলাডারে বিদেশ পাডাইছি। অহন তো হিয়ান (প্রবাসে) আমার পুতেরে খাবার দেয় না। একটা ঘরের বাইরে তালা মাইরা বন্দি কইরা রাখছে। কারো সাথে কথা কইতেও দে না।
খাওন ও দেয় না। হুদা পানি খাইয়া নাকি বাইচ্চা আছে। অহন তো আমার জামাই ও স্বজনরা আমার সাথে বিষয়ডা নিয়া ঝগড়া করতাছে। পরিবারটার সব জায়গায় অশান্তি। আমি অহন টেহা পয়সা চাই না। পুলাডারে ফেরৎ চাই। এমন অভিযোগ করেছেন আরো ২৫-৩০ জন নারী পুরূষ। তাদের প্রতারিত হওয়ার সত্যতাও মিলিছে। তাদের প্রত্যেকেরই অভিযোগ তুল্লাপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে ইরফান ও ইরফানের স্ত্রী পারূল বেগমের উপর। সরকার ও দেশবাসীর কাছে তাদের দাবী তাদের সন্তানদের সুস্থ্য ও জীবিত অবস্থায় দেশে ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা করা হউক। সকলেই বলেন, টাকা চাই না ছেলেকে ফেরৎ চাই। পাচারকারীদের দৃষ্টান্তর্মলক বিচার দাবী করছি। জানা গেছে, ১৯৯৫ সালের ২ আগষ্ট ২১টি শর্তে তুল্লাপাড়া গুচ্ছগ্রামের প্রতিটি পরিবারকে আট শতাংশ করে জায়গা বন্দোবস্ত দেন সরকার। এখানে উপজেলার ৩০টি হতদরিদ্র পরিবার বসবাস করে আসছে। এর মধ্যে পারূল-ইরফান দম্পত্তির পিতা মোহাম্মদ আলীও ঘর পায় সেই গুচ্ছগ্রামে। কয়েক বছর পূর্বে ইরফান আরব আমিরাতে যায়। সেখানে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন বাংলাদেশ থেকে মানুষ পাচারের কাজে। সেই সূত্রেগত এক বছর ধরে গুচ্ছগ্রামের বেকার যুবকদের পরিবারকে টার্গেট করে ইরফানের স্ত্রী পারূল। পারূল বিভিন্নভাবে তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেন।
এর মধ্যে গুচ্ছগ্রামের কিছু পরিবারের নারীদের ‘মা’ বলে ডাকতে থাকেন। সেই সম্পর্কের জের ধরে অনেকের কাছেই পারূল ধর্ম মেয়ে হিসেবে পরিচিতি পায়। পারূল লাখ টাকা বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশ পাঠানোর কথা বলে স্থানীয় ৩০ জন যুবকের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় টাকা নেন। এর মধ্যে ১২ জনকে বিদেশ পাঠানো হলেও অন্যরা অপেক্ষা দুবাই যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। তারা জানতে পারেন প্রবাসে থাকা যুবকদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। ওরা সকলেই কষ্টে আছেন। উল্টো বাড়ি থেকে পাঁচ লাখ টাকা পাঠানোর কথা বলা হচ্ছে। দেশে থাকা অন্য যুবকরা দালালের বাড়িতে ভিড় করছেন। টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছেন অনেকে।
দালাল পারূল-ইরফান দম্পত্তির বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, অনেকেই আসছেন টাকা ফেরত চাইতে। কিন্তু পারূল ঘর থেকে বের হয়নি। তিনি সংবাদিক পরিচয় পেয়ে ঘরের একটি কক্ষে দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে থাকেন। এ সময় কথা হয় ইরফানের বাবা মোহাম্মদ আলীর সাথে। বিদেশ পাঠানোর কথা বলে টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, আমার ছেলে ও ছেলের বৌ পারূল বাড়ি থেকে দেড় লাখ ও দুবাই থেকে ডলারের মাধ্যমে দুই লাখ টাকা করে নিয়েছে। কিন্তু আমার ছেলে যার কথায় টাকা নিয়েছিল সেই লোকও প্রতারক। সে সকল টাকা নিয়া পালাইছে।
ভুক্তভোগী একাধিক পরিবারের অভিযোগ, প্রতারণা করে বিদেশ নিয়ে এখন আবার পাঁচ লাখ টাকা করে দাবি করছে। টাকা দিলে দেশে পাঠানো হবে। প্রবাসে থাকা বারো জনের পাসপোর্ট ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দালাল চক্র জানিয়ে দিয়েছে টাকা না দিলে পাসপোর্ট দিবেন না। আব্দুল কাইমু নামে এক অভিভাবক বলেন, লাখ টাকা বেতনের কথা কইয়া সাড়ে চার লাখ নিয়ে আমার ছেলেরে বিদেশ পাঠাইছি। কাজ নাই। বেতনও নাই। তালাবদ্ধ এককক্ষে আমার ছেলে বন্দি অবস্থায় আছে। পানি খাইয়া জীবনডা বাছাইতাছে। আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে। কিন্তু অহন আমার ছেলে না খাইয়া মরনের দিকে যাচ্ছে। আমি টেহা চাই না ।এহন আমার ছেলেরে দেশে ফিরাইয়া দেওক।
নাছির পাঠান বলেন, দালালের খপ্পরে পইরা তিন বিঘা জমি বেইচ্ছা পোলাডারে দুবাই পাঠাইছি। কইছিন আশি হাজার টেহা বেতন হইব। কিন্তু অহন আমার পোলারে একটা ঘরে বন্ধি কইরা পাসপোর্ট নিয়া গেছে। গত ১২ দিন ধইরা পানি খাইয়া জীবনডা বাচাই রাখছে। আমরা গরীব মানুষ। এহন কার কাছে গেলে আমার পোলা ফিরত পামু। মো. উল্লাস পাঠান বলেন, আমার ভাইসহ বেশ কয়েকজনরে দালাল ইরফান বেশি টাকা বেতনের কথা কইয়া বিদেশ নিছে। এহন সবাইরে একটা ছোট ঘরে তালা মাইরা পাসপোর্ট নিয়া পালাইছে। দুই সাপ্তাহ ধইয়া সবাই উপাস (ক্ষুধার্ত)। দালাল কইছে প্রতি জন যদি পাঁচ লাখ টাকা কইরা দেয় তাইলে সবার পাসপোর্ট ফিরত দিব এবং দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। আমরা জায়গা-জমি আর এনজিও থেইক্যা ঋণ নিয়া চার লাখ টাহা খরচ কইরা বিদেশ পাঠাইছি। এহন পাঁচ লাখ টাকা কই পামু। মুঠোফোনে কথা হয় প্রতারণরা শিকার দুবাই শহরের একটি ঘরে বন্ধি থাকা জয়নাল মিয়ার সাথে। তিনি জানান, আমরা গুচ্ছগ্রামে সরকারের দেওয়া ঘরে থাকি। সমিতি থেকে ঋণ আইন্যা আব্বা টাকা দিছে দালাল ইরফানরে। আমরা ১০-১২ দিন ধইরা কুছতা খাইনা। পেডের মধ্যে খিদার জ্বালা।
আর বাড়িত ঋণের জ্বালা। এহন আমরা আত্মহত্যা করন ছাড়া আর কোন উপায় নাই। স্থানীয় ইউপি সদস্য রশিদ মিয়া বলেন, পরিবারের স্বচ্ছলাত ফিরাতে মহাজনের চড়া সুদ, জমি বিক্রি ও এনজিও থেকে ঋণ করে প্রতারক ইরফানের হাতে টাকা তুলে দিয়েছে এলাকার বেশ কিছু পরিবার। এখন আরো কিছু পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার চেষ্টা করছে। এখন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নাছির মিয়া বলেন, গুচ্ছগ্রামের বেশ কয়েকজন আমার কাছে অভিযোগ করেছে যে, পারূল ও ইরফান মোটা বেতনে প্রবাসে নেয়ার কথা বলে দরিদ্র পরিবারের লোকজনের লাখ লাখ টাকা খাতিয়ে নিয়েছে। দুবাই নিয়ে এখন পাসপোর্ট ছিনিয়ে নিয়ে তাদেরকে বন্দি করে রেখেছে। আমরা স্থানীয় ভাবে বিষয়টি নিস্পত্তির চেষ্টা করছি।
নাসিরনগর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহাগ রানা বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ বড় অপরাধ। ভুক্তভোগীর পরিবারগুলো থানায় লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নিবো।