ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের নরসিংহপুর (আজবপুর) এলাকায় পাচারকারীর কবল থেকে ৮০ কেজি গাঁজা আটকের পর চলছে গায়েব করার নাটক। নায়ক গ্রাম পুলিশ আব্দুর রহমান ও তার সহযোগি মেরাজুল ইসলাম। বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন তারা। সাথে লাপাত্তা মিলনও। আর নিজেকে রক্ষা করতে কৌশলে ডাকাতির আওয়াজ তুলেছিলেন পাচারকারী স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ট স্বজনখ্যাত মিলন। ঘটনার পরক্ষণেই একেবারে নীরব চেয়ারম্যান। মাদক উদ্ধারের পরিবর্তে ডাকাতির ব্যাখ্যা দেওয়ায় চেয়ারম্যানের উপর ক্ষুদ্ধ হয়েছেন ইউএনও। ৭ দিন পরও কিছুই জানেন না সংশ্লিষ্ট বিট অফিসার এস আই নুরনবী। ৯ দিন পরও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি লিখিত ভাবে জানাননি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির। এখন তিনি বলছেন, আটককৃত গাঁজা আব্দুর রহমানের কাছে আছে। পরিমাণ জানার ও উদ্ধারের চেষ্টা করছি। ওসি বলছেন ওই মাদক উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। উদ্ধার না করতে পারলে তো কিছু করা যাবে না। তবে স্থানীয় লোকজন মাদক সিন্ডিকেটের অনেক গুরূত্বপূর্ণ তথ্য জানলেও ভয়ে প্রকাশ্যে কথা বলছেন না।
সরজমিন অনুসন্ধান ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, বর্ষাকালে সরাইল থেকে নৌকায় মাদকদ্রব্য পাচারের দুই গুরূত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই আঞ্চলিক সড়কের ধর্মতীর্থ এলাকার পুটিয়া ব্রীজের নীচ ও চুন্টা ইউনিয়নের সরাইল-অরূয়াইল সড়কের লোপাড়া ব্রীজের পাশের ঘাট। এই দুই জায়গা দিয়েই নদীপথে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাদকদ্রব্য পাচার করছে একটি সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেটের সদস্য অনেক। পর্দার আড়াল থেকে তাদেরকে শেল্টার ও পুঁজি দিচ্ছেন ছদ্মবেশী কতিপয় সুশিল। তাদের রয়েছে পছন্দের নৌকা ও মাঝি। এই দলেরই অন্যতম পাচারকারী চুন্টার ঘাগড়াজোর গ্রামের মিন্নত আলীর ছেলে বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যানের স্বজন মিলন মিয়া। গত ২২ জুলাই বাদ আছর মিলন দুই ব্যক্তির মাধ্যমে লোপাড়া থেকে জাহের মিয়ার নৌকায় করে মাদকের বড় চালান মেঘনার দিকে পাচার করে। বিষয়টি জেনে তারা সুমন মিয়ার নৌকায় করে তাদের পেছনে ধাওয়া করেন নরসিংহপুর গ্রামের প্রয়াত মন’ মিয়ার ছেলে গ্রাম পুলিশ আব্দুর রহমান ও একই গ্রামের আক্কল মিয়ার ছেলে মেরাজুল ইসলাম। ঘাগড়াজোর ও নরসিংহপুর গ্রামের মাঝখানে হাওরে মাদকদ্রব্য বহনকারী নৌকাটিকে আটক করে প্রায় ৮০ কেজি গাঁজা আটক করেন। গাঁজা গুলো আব্দুর রহমানদের হেফাজতে নিয়ে যান। পরবর্তীতে লোভ পড়ে গাঁজা গুলো আত্মসাতের পরিকল্পনা করেন তারা।
তাই পরিমাণ কম বুঝাতে দুটি প্যাকেট সামনে রেখে নৌকায়-ই ভিডিও ধারণ করেন। ঘটনাটি দেখে ফেলেন গ্রামের একাধিক ব্যক্তি। চারিদিকে শুরূ হয় নানা কানাঘুষনা। চারদিন পর মূল বিষয়টি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ২৬ জুলাই শুক্রবার গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে গাঁজা আটকের কথা স্বীকার করলেও পরিমাণ বলতে গড়িমসি করেন আব্দুর রহমান। আত্মগোপনে চলে যান মিলন ও মেরাজুল। এক সময় তারা তিনজনই বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। নিজেকে রক্ষা করতে ফাঁকে মাঝি জাহেরকে দিয়ে সুমন চেয়ারম্যানকে জানায় নদীতে তার নৌকা থেকে ৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা ডাকাতি করেছে আব্দুর রহমান। ওই গ্রামে গিয়ে চেয়ারম্যান জানতে পারেন ডাকাতি নয়, মিলনের মাদক আটক হয়েছে। এরপরও তিনি ডাকাতির কথা বলায় ইউএনও ক্ষুদ্ধ হন। আব্দুর রহমানের কাছ থেকে মাদক উদ্ধার করার নির্দেশ দেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে চুন্টা এলাকার ব্যক্তি বলেন, এখানে জনপ্রতিনিধিদের সাথে মিলে সবকিছু ম্যানেজ করেই মিলন গংরা দীর্ঘদিন ধরে মাদক পাচারের ব্যবসা করছে। সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। চোখে অনেক কিছু দেখি। জীবন শেষ হয়ে যাবে। তাই কথা বলি না। নরসিংহপুর গ্রামের একাধিক ব্যক্তি বলেন, প্রথমে আব্দুর রহমান প্রশাসনের কাছে জমার কথা বলেছে। এখন লুকোচুরি খেলছে। আত্মসাৎ পাকাপোক্ত করণের পথে হাঁটছে।
বড় ধরণের শেল্টার আছে বলেই আব্দুর রহমান মাদকের চালান গায়েব করার চেষ্টা করছে। রশিদ মিয়া, আরজু মিয়া ও ছায়েব আলীরা চেয়ারম্যানকে নিয়ে ঘটনাটি নিস্পত্তির বিষয়ও চাউর করেছেন তারা। আবার পুলিশ ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না মিলন ও মেরাজুল। চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির গ্রাম পুলিশ আব্দুর রহমান কর্তৃক গাঁজা আটকের বিষয়টি উনার নলেজে থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, মিলন আমার কিছুই হয় না। জাহের মাঝির মাধ্যমে ডাকাতির খবর পেয়েছিলাম। বিট অফিসার ৩১ জুলাই পর্যন্ত এ বিষয়ে আমাকে কিছুই জানাননি। আমি গতকাল (৩০ জুলাই) ইউএনও স্যার ও ওসি মহোদয়কে মাদক আটকের বিষয়টি জানিয়েছি। বর্তমানে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। আব্দুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, আমি এলাকার বাহিরে আছি। যা বলার আগে বলছি। আমাকে মাফ করে দিন। আমার কাছে আপনারা আর কিছু জানতে চায়েন না। এখন এই বিষয়ে কিছুই জানি না।
এলাকায় চলতে গেলে অনেক কিছু ছাড় দিতে হয়। নতুবা ছেলে মেয়ে নিয়ে বিপদে পড়ে যাব। পরে আবার মাদকের বড় চালান ধরে আপরাদেরকে জানাব। আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। এ বিষয়ে জানতে চুন্টা ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা বিট অফিসার এস.আই নুর নবীর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। সরাইল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সোহাগ রানা বলেন, এটি আমি আসার আগের ঘটনা। বাই দ্যা বাই শুনেছি। বিট অফিসার বিষয়টি জানত না। উনাকে বলেছি, চৌকিদারকে ধর। কোথায় রেখেছে সেটা বিষয় না। গাঁজা তাকে দিতে হবে। গাঁজাটা বেহাত হয়ে গেলে সমস্যা। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেজবা উল আলম ভূঁইয়া বলেন, দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের উচিত এমন গুরূত্বপূর্ণ বিষয় দ্রূততম সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানানো। যেটা এখানে করা হয়নি। উনারা এই কাজটি ঠিক করেননি। এতে করে ক্ষতি হয়েছে।